- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন
১৯৭০ সালের নির্বাচন অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন ছিল। এ নির্বাচনের ফলাফল ছিল বাঙালির জাতীয় উত্থানের পরিচয়বাহী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে না নেওয়ায় পাকিস্তান তার ক্রান্তিকালে উপনীত হয়। পূর্ব বাংলায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৫ ও ২২ অক্টোবরের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ ডিসেম্বর। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বেশকিছু নির্দলীয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল দু'ডজনের মতো।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে- আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, নিজাম-ই-ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে- পূর্ব বাংলার জনগণের প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি। তবে এ নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো কোনো রাজনৈতিক দলই আসনের সব কটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নি। উপরন্তু পূর্ব বাংলার একসময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ, ভাসানী) ভোটে মুক্তি আসবে না শ্লোগান তুলে নির্বাচন বয়কট করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান অংশের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, বাকি ২টি আসনের মধ্যে ১টি লাভ করেন পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এবং অপরটি লাভ করেন নির্দলীয় প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরী।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৯ ভাগ আওয়ামী লীগের অনুকূলে যায়। অন্য ১২টি আসনের ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং একটিতে জামায়াত-ই-ইসলামী জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের সব কটিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি।
অপর দিকে, জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ৮৩টি আসনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি জয়লাভ করে। আর প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪২.২ ভাগ পায়। বাকি ৫৫টি আসনের ৯টিতে মুসলিম লীগ (কাইউম খান), ৭টিতে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়- ই-পাকিস্তান, ৬টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ওয়ালী খান), ৭টিতে জমিয়তে উলামা-ই-ইসলামী, ৪টিতে জামায়াত-ই-ইসলামী, ২টিতে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এবং ১৩টিতে নির্দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের ৫টিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং ১টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ, ওয়ালী খান) জয়লাভ করে। মহিলা আসনসহ পাকিস্তান পিপলস পার্টির মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনই স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব (Importance of the election of 1970)
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের স্থান লাভ করে। পাকিস্তানি রাজনীতিতে এ নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল যেমন অপরিসীম, তেমনি সুদূরপ্রসারী। নিম্নে ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. পূর্ব বাংলার জনগণের বিজয়: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার শোষিত, বঞ্চিত মানুষের বিজয় সূচিত হয়। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের অধিকার ও বৈধতা অর্জন করে।
২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। এ নিবার্চনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি লাভ করে।
৩. বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের স্বীকৃতি অর্জন: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের গৌরব অর্জন করেন।
৪. বাঙালিদের মুক্তির চেতনা স্ফুরিত হয়: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ ও নিষ্পেষণ থেকে বাঙালিদের মুক্তির চেতনাকে ব্যাপকভাবে জাগিয়ে তোলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের গতিকে বেগবান করে তোলে।
৫. ৬ দফার স্বীকৃতি লাভ: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি বিপুল সমর্থন জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ৬ দফার প্রতি সর্বাত্মক আস্থার প্রতিফলন ঘটায়। ৬ দফার মধ্য দিয়ে তারা পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিলাভের আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
৬. পাকিস্তানের সংহতির সংকট প্রবলতর হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সংহতির সংকট আরও প্রবল রূপ লাভ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের যে চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। এতে পাকিস্তানের দু'অংশের জনগণের মধ্যে সংহতির ফাটল বা দূরত্ব আরও দ্বিগুণ আকার ধারণ করে।
৭. পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্লেষকরা পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক বলে অভিহিত করেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করে নি। অন্যদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপল্স পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন পায় নি। ফলে দুটি দলই অঞ্চল ভিত্তিক দলে পরিণত হয় এবং নিজ নিজ দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচির প্রতি অনঢ় থাকে। যার পরিণতি পাকিস্তানের ভাঙন ত্বরান্বিত করে।
৮. আত্মপ্রত্যয় ও জাগরণ সৃষ্টি: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব আত্মপ্রত্যয় ও জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ আত্মপ্রত্যয় শেষ পর্যন্ত সকল বাধা পেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা অজর্নের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে। তাই বলা হয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।
সর্বশেষে বলা যায়, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উত্থান সূচিত হয়েছিল তার বিজয় ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। এ নির্বাচন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আগমনী বার্তা বহন করে আনে। নতুন স্বপ্নে জেগে ওঠে বাঙালি জনগণ। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ