- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ
গণহত্যা ও নির্যাতন- ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বড় ধরনের একটি জনযুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধ হলেও এর পরিধি, এর নৃশংসতা ও ঘটনা ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীতে এরূপ নৃশংস ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাসে বিশ্ববিবেককে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে সেটি হচ্ছে গণহত্যা ও নির্যাতন। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে বাঙালির ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে গণহত্যাকে পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র হলোকাস্টের সাথে তুলনা করা যায়। একমাত্র হলোকাষ্টকে বাদ দিলে পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ গণহত্যা ও নির্যাতনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। এমনকি ১২৫৮ সালে হালাকুখান বাগদাদে যে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ছিলেন তাকেও স্নান করে দেয়।
অপারেশন সার্চলাইট: অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বসে 'অপারেশন সার্চলাইট' (গণহত্যার নীল নকশা) প্রণয়ন করা হয়। এ নীল নকশা প্রণয়নে ছিলেন- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও খাদেম হোসেন। বস্তুত, এটা ছিল বাঙালি নিধনের জন্য জঘন্যতম কাপুরুষোচিত এক অভিযান।
অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় নিম্নোক্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়:
১. একযোগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশন শুরু হবে।
২. সর্বাধিক রাজনীতিক, ছাত্রনেতা, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার চরমপন্থিদের গ্রেফতার করতে হবে। বিশেষ সার্ভিস গ্রুপের এক প্লাটুন কমান্ডো সৈনিক শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রমণ ও তাকে গ্রেফতার করবে।
৩. ঢাকার অপারেশন শতভাগ সফল করতে হবে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করতে হবে।
৪. সেনানিবাসের নিরাপত্তা অবশ্য নিশ্চিত করতে হবে।
৫. যাবতীয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। টেলিফোন, একচেঞ্জ, রেডিও, টিভি, টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস, বৈদেশিক কনস্যুলেটসমূহের ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিতে হবে।
৬. ইপিআর সৈনিকদের নিরস্ত্র করে তদস্থলে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের পাহারায় নিয়োগ করতে হবে।
৭. প্রথম পর্যায়ে এ অপারেশনের এলাকা হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেট চিহ্নিত করা হবে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে প্রয়োজনে বিমানযোগে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অপারেশন সার্চলাইটের নীল নকশা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এক রাতেই নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে এক লক্ষ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনা শেষ না করে ২৫ মার্চ সন্ধ্যে সাতটায় বিমানযোগে হঠাৎ ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে বাঙালিদের আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে যান। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'আমি এদেশের মানুষ চাই না, মাটি চাই।' ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ পেয়ে গভর্নর টিক্কা খান তার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরের নিরীহ, নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ট্যাঙ্ক, মেশিন গান, মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। হানাদারবাহিনী প্রথমেই হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে (বর্তমান জহিরুল হক হল)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আক্রমণের কারণ হলো, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার বলা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা রকেট হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় হল দুটিতে। পরে রুমে রুমে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রদের গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। শত শত ছাত্রদের লাশ সেদিন এ দুটি হলের সিঁড়িতে, বারান্দায় স্তূপ হয়েছিল। সৈন্যদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল দুটি ছাত্রাবাসের একটি প্রাণীও যেন বেঁচে না থাকে এবং ঘটলোও তাই। দারোয়ান, সুইপার এবং আবাসিক শিক্ষকদেরও একইভাবে হত্যা করা হয়। মোট ১১ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তাদের অধিকাংশ ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের। রোকেয়া হলে ছাত্রীদের নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। পিলখানায় অবস্থিত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর ব্যারাকের (বাঙালিদের নিয়ে তৈরি সীমান্ত রক্ষী-বাহিনী- বর্তমান বিজিবি) সকল প্রাণীকেও হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিলখানা জ্বলে উঠল। চলল গণহত্যা। যারা আত্মসমর্পণ করল তাদেরকেও মেরে ফেলা হলো। একইভাবে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা চলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পুরান ঢাকায়, তাঁতিবাজার, শাখারি পট্টি, কচুক্ষেত, মিরপুর, রায়ের বাজার, ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত উক্ত সামরিক অভিযানের নাম 'Operation search light' অপারেশন সার্চলাইটের হত্যাযজ্ঞ কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না; কুমিল্লা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, সৈয়দপুর, সিলেটসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে ও জনপদে তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলে। বাঙালির ইতিহাসে এ রাত 'কালরাত' নামে পরিচিত। এ রাতে প্রায় এক লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। হত্যাকাণ্ড চলছে এমন এক সময়ে টিক্কা খানকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কেন এতো মানুষকে হত্যা করছেন? জবাব দিয়েছিলেন, আমি মানুষ নিয়ে ভাবছি না, ভাবছি দেশকে নিয়ে (উৎস: ম্যাসাকার রবার্ট পেইন পৃ.-৭৮)। রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষ একটি কমান্ডো গ্রুপ ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়ি থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। পরের দিন সকাল থেকে চারদিক এক থম থমে পরিবেশ বিরাজ করে। যে মানুষগুলো ঢাকা শহরকে প্রাণ চঞ্চল করে রাখত, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা উচ্ছ্বসতায় ভরে রাখত ক্যাম্পাস, সেই ছাত্ররা দলে দলে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে রইল। যারা বেঁচে ছিল তারা তো নির্বাক, তার ওপর সমগ্র মহানগরীতে কারফিউ জারি করা হয়। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। নেই পাখিদের কোনো কোলাহল।
ঢাকার শহর যেন নিরব, নিস্তব্ধ এক মৃত্যুপুরী। অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীর ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মনের মণি কোঠায় বারবার একটি প্রশ্ন উঁকি মারছে, তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি বেঁচে আছেন তো? নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত হয়। কেউ জানে না বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কোথায়? সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষ জানতে পারে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। পৃথিবীতে অনেক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস থাকলেও নিরহ নিরস্ত্র ঘুমাও মানুষকে গণহত্যার ইতিহাস পাওয়া যায় না। যা সংগঠিত করেছিল পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে। সম্প্রতিকালে ২৫ মার্চে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য।
গণহত্যার চেয়ে আরও জঘন্য হচ্ছে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশি সব সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। সমস্ত প্রচার মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশব্যাপী চলে শুধু কারফিউর তাণ্ডবদাহ। এত কিছুর পরও সাইমন ড্রিং-এর মতো কয়েকজন অতি সাহসী সংবাদিক ঢাকা শহরের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের চিত্র অতি গোপনে ওয়াশিংটন পোস্ট ও লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেন। সাইমন ড্রিং-এর পাঠানো তথ্যচিত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মূল্যবান উপাদান।
২৫ শে মার্চ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ও বড় বড় শহরগুলোতে যে নির্বিচারে গণহত্যা-নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়েছিল তা ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। এই দীর্ঘ ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় ৩০ লাখেরও বেশি বাঙালি প্রাণ হারায়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে হলোকাস্টের পরে সর্বোচ্চ গণহত্যা। গণহত্যার পাশাপাশি আড়াই লক্ষের বেশি মা-বোন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সবকিছু ফেলে শরণার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয় এক কোটি বাঙালি এবং প্রায় ছয় কোটি বাঙালি নিজ দেশে দীর্ঘ ২৫৮ দিন অবরুদ্ধ জীবন অতিবাহিত করে। সর্বত্র আতঙ্কগ্রস্ত থেকেছে কখন কী ঘটে যায় তার জন্য। এক কথায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কারো মনেই শান্তি ছিল না, ছিল না স্বস্তি।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

