- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের ভবের পাড়া গ্রামের আম্রকাননে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারাই স্বাধীন বাংলার প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, যা ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১১ এপ্রিল "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" থেকে তাজউদ্দিন আহমেদ এই নতুন মন্ত্রিসভার কথা ঘোষণা করেন এবং এই মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। শপথ গ্রহণের ২৪ ঘণ্টা পর পাকিস্তান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে মেহেরপুর দখল করে নেয়। ফলে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার হলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালের ২২শে ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন-
১। প্রেসিডেন্ট- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী)
২। উপ-রাষ্ট্রপতি - সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকারবলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান)
৩। প্রধানমন্ত্রী- তাজউদ্দিন আহমেদ
৪। অর্থমন্ত্রী- এম. মনসুর আলী
৫। স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ, পুনর্বাসন, কৃষি ও আইনমন্ত্রী- এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান
৬। পররাষ্ট্র মন্ত্রী - খন্দকার মোশতাক আহমেদ
৭। সেনাবাহিনী প্রধান - কর্নেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানী
৮। চিফ অব স্টাফ - কর্নেল (অব.) আবদুর রব
৯। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ- গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
(এদের মধ্যে ২-৫ এই জাতীয় চার নেতার নাম ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর জেলখানায় এই জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে কারণে প্রতি বছর ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস পালন করা হয়।)
মানচিত্র দেখে মুক্তাঞ্চল এবং একই সঙ্গে নিরাপদ ও কলকাতার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ আছে এমন একটি স্থানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্যে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার আম্রকানন নির্বাচন করা হয়। ১৭ এপ্রিল বেলা ১১ টায় বৈদ্যনাথ তলায় মন্ত্রিসভার অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। একজন তরুণ সিভিল অফিসার তওফিক ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা এলাকাটির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৭ এপ্রিল সকাল ১১.১০ মিনিটে অভিষেক অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানে মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, শতাধিক ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিক ও প্রচার মাধ্যমকর্মী এবং স্থানীয় অধিবাসী ও কিছু সংখ্যক 'মুক্তিযোদ্ধা' উপস্থিত ছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত (আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি) পরিবেশনের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান। গার্ড অব অনার শেষে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানী একটি ছোট্ট মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র বা স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। নবগঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাম হলো 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তে আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই কলঙ্কময় ঘটনার ২১৪ বছর পর পলাশীরই নিকটবর্তী স্থানে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য পুনরায় উদিত হলো। বৈদ্যনাথ তলার নামকরণ করা হলো মুজিবনগর। বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তারা নতুন রাষ্ট্রের জন্য সহানুভূতি, সাহায্য ও স্বীকৃতি কামনা করেন।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of independence)
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় গঠিত হলে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র' শীর্ষক -গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৪র্থ পৃষ্ঠায় উক্ত ঘোষণা ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ আছে। ঘোষণা সংক্রান্ত অংশের বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ-
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে, শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
এবং
যেহেতু আহুত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে পালনের অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছে। চালাইতেছে।
এবং
যহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযোগ করে দিয়েছে।
এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, মানসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের ওপর তাদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন।
সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি-
এবং
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন। রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকারের প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন।
তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন, রাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থ ব্যয়ের এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম। এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

