- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য এবং মানবাধিকার
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য এবং মানবাধিকার
নাগরিকতা Citizenship
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম হলো নাগরিকতা বিষয়ক আলোচনা। এক অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞানও বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নাগরিক হিসেবে মানুষের কার্যাবলি পর্যালোচনা করে। আর তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য নাগরিকতার পূর্ণ উপলব্ধি একান্তই আবশ্যক।
নাগরিকতা বলতে রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে নাগরিকের মর্যাদাকে বোঝায়। আর নাগরিক অর্থ যিনি রাষ্ট্রের অধিবাসী এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন। অর্থাৎ নাগরিক বলতে আমরা তাকে বুঝি যিনি নগরের অধিবাসী এবং কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিক শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল (Aristotle) বলেন, "সেই ব্যক্তিই নাগরিক যিনি নগর রাষ্ট্রের শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।"
এরিস্টটল প্রাচীন গ্রিসের নগ্ন রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে বসে যেই পরিবেশে নাগরিকের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন বর্তমানে তা অচল। কারণ বর্তমানে জাতীয় রাষ্ট্রের আবহে নাগরিকের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। বলা হয়, সেই ব্যক্তি নাগরিক যিনি কোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন।
ডঃ গার্নার মনে করেন, "রাষ্ট্রের সকল সদস্যই নাগরিক। আর নাগরিকতা হলো একজন নাগরিকের মর্যাদা।"
অধ্যাপক কেলসন (Prof. Kelson) বলেন, "নাগরিকতা রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে কোনো ব্যক্তির, গদমর্যাদা।" ("Citizenship is the status of an individual who legally belongs to a certain state.")
অধ্যাপক লাস্কি মনে করেন, "নাগরিকতা হলো, অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা জনকল্যাণের জন্য ব্যক্তির সুশিক্ষিত বিচার বুদ্ধির যথার্থ প্রয়োগ।" ("Citizenship is the contribution of one's instructed Judgement of public good.")
সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নাগরিকতা এবং নাগরিকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সেই সাথে নাগরিক ও বিদেশির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। কারণ বিদেশিরা অন্য রাষ্ট্রে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন, তাঁরা নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকেন এবং তাঁরা সামাজিক অধিকার ভোগের সুযোগ পেলেও রাজনৈতিক অধিকার (যেমন- নির্বাচনে ভোট প্রদান বা প্রার্থী হওয়া) ভোগ করতে পারেন না।
নাগরিকতা লাভের পদ্ধতি (Methods of acquiring citizenship).
দুটি পদ্ধতিতে নাগরিকতা লাভ করা যায়। যথা: (ক) জন্মসূত্রে নাগরিক এবং (খ) অনুমোদন সূত্রে নাগরিক। যারা জন্মসূত্রে রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করেন তাদেরকে জন্মসূত্রে, নাগরিক বলা হয়। আর যারা কতগুলো শর্ত পূরণ করে অনুমোদনকারী রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করেন তাদেরকে অনুমোদনসূত্রে নাগরিক বলা হয়।
(ক) জন্মসূত্রে নাগরিক জন্মসূত্রে নাগরিকতা লাভের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যথা:
(i) জন্মস্থান নীতি (Jus soli) এবং
(ii) জন্মনীতি (Jus sanguinis)।
(i) জন্মস্থান নীতি (Jus soli): জন্মস্থান নীতি অনুযায়ী নাগরিকতা নির্ধারিত হয় জন্মস্থানের দ্বারা। অর্থাৎ শিশুর পিতামাতা যে রাষ্ট্রের নাগরিকই হোন না কেন, শিশুটি যে রাষ্ট্রে ভূমিষ্ঠ হয় সেই রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করে। যেমন- বাংলাদেশের কোনো পিতামাতার সন্তান যদি ব্রিটেন কিংবা আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করে তাহলে ঐ সন্তান ব্রিটেন বা আমেরিকার নাগরিক হবে। কোনো শিশু যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের পতাকাবাহী জাহাজ, বিমান কিংবা দূতাবাসে জন্মগ্রহণ করে তাহলে সে সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হবে। ব্রিটেন, আমেরিকা, বাংলাদেশ এই নীতি অনুসরণ করে।
(ii) জন্মনীতি (Jus sanguinis): এই নীতি অনুযায়ী শিশু যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তার পিতামাতা যে রাষ্ট্রের নাগরিক সেও ঐ রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করবে। প্রাচীনকালে গ্রিক, রোমান ও জার্মানিতে এই নীতিতে নাগরিকতা লাভ করা যেত। বর্তমানকালে ফ্রান্স, ইতালি, জাপান এবং বাংলাদেশে এই নীতি মেনে চলা হয়। যেমন- ফ্রান্সের কোনো পিতা-মাতার সন্তান, যদি চীন বা রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করে তাহলে ঐ সন্তান ফ্রান্সের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে।
(খ) অনুমোদনসূত্রে নাগরিকতা লাভ (Citizenship by naturalisation): নাগরিকতা অর্জনের দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো অনুমোদনসূত্রে। কতকগুলো শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এই পদ্ধতিতে নাগরিকতা লাভ করা যায়। ড. গার্নার বলেন, "ব্যাপক অর্থে নাগরিকত্বের অনুমোদন বলতে যেকোনোভাবে কোনো বিদেশির নাগরিকত্ব অর্জনকে বোঝায়।" সাধারণত ছয়টি শর্ত পূরণ করে যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া যায়। যেমন- (১) উক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে (২) সেনাবাহিনীতে যোগদান করে (৩): সরকারি চাকরি গ্রহণ করে (৪) সম্পত্তি ক্রয় করে (৫) ভাষা শিখে (৬) নির্দিষ্ট সময় বসবাস করে। এছাড়া যুদ্ধ, চুক্তি কিংবা নিরাপত্তাজনিত কারণে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেও নাগরিকতা লাভ করা যায়। এসব শর্ত পূরণ করে অনুমোদনকারী রাষ্ট্রের নিকট আবেদন করলে তা যদি মঞ্জুর হয় তাহলেই একজন বিদেশি অনুমোদনসূত্রে নাগরিকে পরিণত হয়।
দ্বৈত নাগরিকতা (Double citizenship)
নাগরিকতা অর্জনের জন্মস্থান নীতি এবং জন্মনীতি একই সাথে মেনে চলার কারণে দ্বৈত নাগরিকতার সৃষ্টি হয়। যেমন- ইতালির কোনো দম্পতি যদি ভ্রমণ উপলক্ষে আমেরিকায় গমন করে এবং সেখানে তাদের সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে ঐ সন্তানের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকতার সমস্যা দেখা দেয়। কারণ ইতালিতে নাগরিকতা নির্ধারণে জনন্মনীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ ইতালির পিতামাতার সন্তান যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক সে সন্তান ইতালির নাগরিক। কিন্তু আমেরিকায় যেহেতু জন্মস্থান নীতি মেনে চলা হয় সেহেতু ঐ সন্তান আমেরিকার নাগরিক। এভাবে একই সাথে দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াকে দ্বৈত নাগরিকতা বলে। এক্ষেত্রে দুটি রাষ্ট্রই তার নিকট আনুগত্য দাবি করতে পারে। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সে যেকোনো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকতা বর্জন করতে পারে।
নাগরিকতার বিলোপ (Loss of Citizenship)
জন্মসূত্রে কিংবা অনুমোদনসূত্রে কতিপয় শর্ত পূরণ সাপেক্ষে যেমন নাগরিকতা লাভ করা যায় তেমনি কতকগুলো কারণে নাগরিকতার বিলোপ ঘটে। যেমন-
১. অনেকেই স্বেচ্ছায় নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকতা পরিত্যাগ করে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করে। এ অবস্থায় সে যখন অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক তখন তার নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বিলোপ হয়।
২. কোনো নাগরিক তার নিজ রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে নাগরিকতা হারাতে পারেন।
৩. উপাধি গ্রহণ করলে তার নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ৩. অন্য রাষ্ট্রে সরকারি চাকরি গ্রহণ, সেনাবাহিনীতে যোগদান, খেতাব বা উপাধি বিলুপ্ত হবে।
৪. রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতির পরিপন্থী কোনো কাজ করলে নাগরিকতার বিলোপ ঘটে।
৫ . কোনো মহিলা অন্য রাষ্ট্রের নাগরিককে বিয়ে করলে সে নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারাবে।
৬. যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ফলে কোনো রাষ্ট্রের এলাকা অন্য রাষ্ট্রের দখলে চলে গেলে তারা দখলদার রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে যায় এবং নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বিলুপ্ত হয়।
৭. মারাত্মক অন্যায় কাজের জন্য রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে বিতাড়ন করলে সে তার নাগরিকত্ব হারায়।
৮. চুক্তির ফলে এক রাষ্ট্রের এলাকা অন্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে সে এলাকার নাগরিকরা সংযোগকারী রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ