- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ফরাসি বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণ
১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও সর্বহারা জনসাধারণের কঠোর প্রতিবাদ বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করে। কোনো বিশেষ কারণ বা আকস্মিক কোনো ঘটনার দ্বারা এই মহাবিপ্লব সংঘটিত হয়নি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কারণের সমাবেশের ফলে এই বিপ্লবের সূত্রপাত হলেও রাজনৈতিক কারণকে এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ বলা চলে।
রাজার স্বেচ্ছাচারিতা
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি রাজতন্ত্র ছিল স্বৈরাচারী। রাজা ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস। তিনি ছিলেন একাধারে শাসক, বিচারক এবং আইন প্রণেতা। তিনি ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। চতুর্দশ লুই বলতেন, 'আমিই রাষ্ট্র' এবং ষোড়শ লুই বলতেন 'আমি যা ইচ্ছা করি তা-ই আইন'।" এরূপ স্বৈরাচারী শাসনে জনমতের কোনো স্থান ছিল না এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার লেশমাত্র ছিল না। লেত্রে-ডি-ক্যাশে (lethre de cachct) নামক গ্রেফতারি পরোয়ানার উপর রাজার স্বাক্ষর নিয়ে যেকোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা যেত। ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেল নামক ফিউডাল পার্লামেন্ট-এর অস্তিত্ব বিনষ্ট করে রাজা দেশের সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কেন্দ্রীভূত করেন।
অত্যাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ রাজতন্ত্রের এরূপ সর্বাত্মক ক্ষমতার সদ্ব্যবহার চতুর্দশ লুই তার কর্মক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা দ্বারা করতে সক্ষম ছিলেন। তার উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ছিলেন দুর্বল, বিলাসী ও শাসনকার্যে সম্পূর্ণ উদাসীন। ফলে চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। কারণ তার শাসনকার্যের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দেশের গৌরব অর্জন। সপ্তদশ শতাব্দীতে রিশল্যু, ম্যাজারিন ও কোলবার্টের ন্যায় সুযোগ্য মন্ত্রীরা ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের জন্য একটি সম্মানজনক স্থান তৈরি করেন। কিন্তু পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুই শাসনব্যবস্থায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন এবং তাদের হাতে রাজতন্ত্র একটা অত্যাচার ও উৎপীড়নের যন্ত্রে পরিণত হয়। তদুপরি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ফ্রান্সের শোচনীয় ব্যর্থতার ফলে জনগণ তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে।
শাসন ও বিচারব্যবস্থায় নৈরাজ্য
সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেও শাসনব্যবস্থায় রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল না। এ সময়ে ফ্রান্স ৪০টি ক্ষুদ্র সামন্ত অঞ্চলে বিভক্ত থাকায় উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করতেন। রাজকর্মচারীদের ক্ষমতা ও সরকারি বিভাগগুলোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট না থাকার দরুন বিশৃঙ্খলা ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারব্যবস্থারও চরম অধঃপতন ঘটে। বিচারব্যবস্থা একদিকে ছিল ব্যয়বহুল, অপরদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত। সমগ্র দেশে কমপক্ষে বিভিন্ন ধরনের ৪০০ আইনকানুন বলবৎ ছিল। আইনের চোখে সকল মানুষ সমান ছিল না। নিজ দায়িত্বের প্রতি উদাসীন বিচারকগণ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সচেষ্ট ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে দেশে বিচারের নামে অবিচার এবং শাসনের নামে কুশাসন চলছিল। ফ্রান্সের জাতীয় সভা ছিল মৃতপ্রায়।
অভিজাত শ্রেণির উত্থান
রাজশক্তির দুর্বলতার ফলে অভিজাত শ্রেণি পুনরায় রাজসভায় নিজেদের প্রাধান্য স্থাপন করে এবং রাজা তাদের ক্রীড়নকে পরিণত হন। দেশের ও দশের কোনো মঙ্গল সাধন না করে তারা নিজ ক্ষমতা ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তৎপর হয়। ইনটেনডেন্টদের সাহায্যে তারা প্রদেশের মানুষকে শাসনের নামে শোষণ করত। এককথায় ভার্সাই রাজসভার পূর্ব গৌরব বিলুপ্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক হ্যাম্পসনের মতে, "শাসনব্যবস্থায় অভিজাত শ্রেণির প্রভাব অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।"
রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
দুর্বল রাজা এবং ক্ষমতাশালী অভিজাত শ্রেণির কারণে দেশের শাসনব্যবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। অথচ ফরাসি নৃপতিগণ তাদের বিলাসিতা, শাসন ও সামরিক অভিযানের কৃতিত্বের জন্য দেশের বিপুল অর্থের অপব্যয় করতেন। ভার্সাই রাজপ্রাসাদ ছিল জাঁকজমক ও বিলাসিতায় পরিপূর্ণ এক স্বর্ণপুরী। ১৮,০০০ কর্মচারী রাজপরিবারের সেবায় নিযুক্ত ছিল। এর মধ্যে ১৬,০০০ কর্মচারী রাজা ও রানির সেবায় নিয়োজিত ছিল। রানির ব্যক্তিগত ভৃত্যের সংখ্যা ছিল ৫০০। প্রিয়পাত্রদের মধ্যে কোটি কোটি মুদ্রা পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করা হতো। বিশেষ করে ষোড়শ লুই-এর স্ত্রী রানি মেরি আঁতোয়ানেত-এর সীমাহীন বিলাসিতা দুঃসহনীয় ছিল। রাজপরিবারের এরূপ অমিতব্যয়িতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ফরাসি জনগণকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত টমাস জেফারসন বলেন, "রানি না থাকলে ফ্রান্সে বিপ্লবই হতো না।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা: অষ্টাদশ শতকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও ফ্রান্স চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ফ্রান্সের বিপর্যয় ঘটে। ঐতিহাসিক বার্নস এবং রালফ এ প্রসঙ্গে বলেন, "France was now crippled almost beyond hope of recovery." আমেরিকা ও ভারতে ইংরেজদের কাছে ফ্রান্স পরাজিত হয়। এসব পরাজয়ের ফলে ফ্রান্সের ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হয় এবং ফরাসি রাজকোষ অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ফরাসি সরকারের ব্যর্থতায় জনগণের কাছে রাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়।"
উপরের আলোচনা থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি রাজশক্তির অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ষোড়শ লুই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ফরাসি জাতিকে শাসন করার নৈতিক অধিকার রাজা হারিয়ে ফেলেছিলেন। রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের দোষ-ত্রুটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অবশেষে তা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং পতন অপরিহার্য হয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

