• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লব

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ফরাসি বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ

ফরাসি বিপ্লব ইউরোপ তথা বিশ্ব ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তৎকালীন প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনসাধারণের কঠোর প্রতিবাদ বিপ্লবের আকারে আত্মপ্রকাশ করে। বহুকালের গ্লানি এই বিপ্লবের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল। বহু কারণের একত্র সমাবেশের ফলেই এই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। এগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ ছিল অন্যতম। ঐতিহাসিক মর্গ স্টিফেনস অর্থনৈতিক কারণের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

আমরা জানি, প্রাক-বিপ্লব যুগে ফরাসি সরকারের প্রধান দুর্বলতাই ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। অথচ সরকারের অপচয় কমানো যায়নি। যেহেতু কৃষক ছিল দারিদ্র্যের চরম সীমায়, নতুন করের বোঝা চাপানো সম্ভব ছিল না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, রাষ্ট্রের আর্থিক সংকটের মুখেও প্রথম দুই শ্রেণি- যাজক ও অভিজাতরা তাদের কর না দেওয়ার বিশেষ অধিকার ছাড়তে রাজি হয়নি। ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই এবং তার মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে অভিজাতদের উপর চাপ সৃষ্টি করার ফলেই অভিজাত বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। অর্থনৈতিক ঘাটতির প্রধান কারণ ছিল, ফ্রান্স ব্যয়বহুল ইউরোপীয় যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিল। এমনও হয়েছিল যে, বাজার থেকে ঋণ গ্রহণ করে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়েছিল। এই ঋণের উপর যে বিপুল টাকা সুদ হিসেবে দেওয়া হতো, তাতে সরকারি আয়ের একটা বড় অংশই খরচ হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত এমন একটা সময় আসে যখন সরকার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

দ্বিতীয় যে অর্থনৈতিক দুর্বলতায় ফরাসি সরকার ভুগছিল তা হলো করভারের অসমতা। এই অসমতা ছিল মানুষে মানুষে এবং এলাকায় এলাকায়। যেহেতু ফ্রান্স ছিল সে সময়ে 'বিশেষ অধিকারের দেশ' সেহেতু যাজক ও অভিজাত শ্রেণি কর না দেওয়ার বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় প্রায় সকল প্রকার প্রত্যক্ষ কর থেকে অব্যাহতি পেত। ফলে ফরাসি রাজকোষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। এভাবে ধনীগণ, যারা রাষ্ট্রকে অধিক কর প্রদান করতে পারত, তারা অল্প দিয়ে আরও অধিক পরিমাণে অর্থ সঞ্চয়ের সুযোগ পাচ্ছিল এবং যারা দরিদ্র তারা রাষ্ট্রকে তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত কর দানে বাধ্য হয়ে ক্রমশ ধ্বংসের পথে অগ্রসর হতে থাকে। কর আদায়ের এই ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির ফলে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা চরমে পৌছে যায়।

করপ্রথা ছিল অন্যায়, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। এই সময়ে রাষ্ট্র কর, ধর্ম কর এবং সামন্ত প্রভুর দায় মেটাতে গিয়ে কৃষকদের আয়ের চার-পঞ্চমাংশ নিঃশেষ হয়ে যেত। প্রত্যক্ষ কর এবং পরোক্ষ কর ছাড়াও নানা রকমের করের তাড়নায় কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। প্রত্যক্ষ কর টেইলি বা ভূমিকর, ক্যাপিটেশন বা আয়কর, ভিংটিয়েমে বা সম্পত্তি কর এবং পরোক্ষ কর গেবেলা বা লবণ কর, এইডস, (মাদক দ্রব্যের উপর কর) আবগারি শুল্ক, দলিলপত্রের উপর কর, আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক প্রভৃতি সবই তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্য বিশেষ করে কৃষকদেরই দিতে হতো। তাই ফরাসি দেশে একটি প্রবাদ আছে- "অভিজাত শ্রেণি যুদ্ধ করে, পুরোহিত শ্রেণি ধর্মকর্ম করে আর জনগণ করের বোঝা বহন করে। "১২ যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়কে এসব কর দেওয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করত। 'দেশের প্রতি কোনো কর্তব্য তাদের ছিল না। অধিকারহীন সম্প্রদায় বিশেষ করে কৃষকদের সুযোগ-সুবিধার বালাই ছিল না, ছিল কেবল দায়িত্ব পালনের তাগিদ। কৃষকদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কার্লাইল মন্তব্য করেছেন, "ফ্রান্সের কৃষকদের এক-তৃতীয়াংশ বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময় আলু খেয়ে জীবন ধারণ করত।

কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল দুর্নীতিপূর্ণ ও নির্যাতনমূলক। কর আদায়ের ভার সরকার এক শ্রেণির মধ্যবর্তী কর আদায়কারীর হাতে দিয়েছিল। তারা সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে এক-একটি স্থানের কর আদায়ের অধিকার পেত। স্বভাবতই কর আদায়ে অত্যাচার করা হতো। তাছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তির আয়ের এক-দশমাংশ ধর্ম কর হিসেবে আদায় করা হতো। যদিও সামন্তপ্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল, তথাপি সামন্ত প্রথার কর আদায়ের রীতি তখনো চালু ছিল। এককথায় বলা যায়, মোট আদায়কৃত করের ৯৬ শতাংশ এ তৃতীয় সম্প্রদায়কে বহন করতে হতো। এ বৈষম্যমূলক নীতির ফলে ফ্রান্সে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় এবং তা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম লক্ষ করে তদানীন্তন ফ্রান্সকে "অর্থনৈতিক ভ্রান্তির জাদুকর" (A Museum of economic errors) বলে বর্ণনা করেছিলেন।

ফরাসি জনসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্দশা রাজতন্ত্রের আর্থিক দুর্বলতার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। চতুর্দশ লুইয়ের সময়ে অনবরত যুদ্ধবিগ্রহের ফলে রাজকোষের অপরিমেয় অর্থ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তার উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুইয়ের সামরিক অভিযান, দুর্নীতিপরায়ণ শাসন, বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতার ফলে ফ্রান্স অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। দেশের এই শোচনীয় অর্থনৈতিক দুর্যোগের দিনে হতভাগ্য ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময়ে মন্ত্রী Turgo and Necker অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য কতিপয় অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

তারা উভয়েই সুবিধাপ্রাপ্ত যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের উপর কর আরোপ করার প্রস্তাব করলে এবং রানির মাধ্যমে ষোড়শ লুইয়ের উপর চাপ দিলে পর পর দুজন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়। এদের পদচ্যুতি ফরাসি অর্থনৈতিক অবস্থাকে এক সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ইতিমধ্যে ১৭৮৭-৮৯ খ্রিষ্টাব্দের অজন্মা ফ্রান্সের অর্থনৈতিক জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। ১৭৮৭-৮৯ খ্রিষ্টাব্দের অজন্মায় ফসল উৎপাদন অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। কৃষক, কারিগর, শ্রমিক এককথায় মেহনতি মানুষের জীবনে দুর্গতি এলেও অধিকারপ্রাপ্ত বা সুবিধাভোগী যাজক ও অভিজাতদের আর্থিক অবস্থার তেমন হেরফের হয়নি। কারণ তারা পরের রোজগারের উপর বেঁচে ছিল। তাছাড়া রাষ্ট্রকে তাদের কর দিতে হতো না। এভাবে গ্রামের কৃষক এবং শহরের কারিগর, শ্রমিক প্রমুখ তাদের আর্থিক দুর্দশার জন্যই ফরাসি রাজতন্ত্র এবং অভিজাতদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বিপ্লব অপরিহার্য করে তুলেছিল। অর্থ সংগ্রহের জন্য বাধ্য হয়ে ষোড়শ লুই ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করেন। জাতীয় সভার অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে রাজার মতভেদ ঘটে এবং প্যারিস ও অন্যত্র ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রায় দুই শত বছর পরে জাতির প্রতি রাজার এই আহ্বান স্বৈরতন্ত্রের চরম ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কথাই ঘোষণা করে এবং এই অধিবেশনকে উপলক্ষ করেই ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত হয়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ