- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ফরাসি বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ
ছোট-বড় নানা কারণের সমষ্টি ছিল ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯-৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্সে সংঘটিত ধারাবাহিক বৈপ্লবিক ঘটনার সমষ্টিকেই সাধারণত ফরাসি বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুবিধাভোগী শ্রেণির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ বিপ্লবের সূচনা হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিচার করলে ফরাসি বিপ্লবকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা- অভিজাত, মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেণি, শহুরে জনগণ ও গ্রামীণ কৃষক। প্রথম পর্যায়ের বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল অভিজাত শ্রেণি, দ্বিতীয় পর্যায়ে বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়াদের হাতে। তৃতীয় পর্যায়ে শহরাঞ্চলে গণবিপ্লব শুরু হয়। সর্বশেষ কৃষকবিপ্লব দেখা দেয়। বিপ্লবের গতি যেমন ছিল বৈচিত্র্যময়, তেমনি ছিল ব্যাপক। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক জীবনে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। পূর্ববর্তী শাসক চতুর্দশ লুইয়ের শাসনামলে টুর্গো ও নেকার অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব করলেও সুবিধাবাদীদের বিরোধিতার মুখে তা কার্যকর হয়নি। ষোড়শ লুই অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব মোকাবিলা করার জন্য নতুন করারোপের সিদ্ধান্ত নিলে প্যারিসের পার্লামেন্ট তার বিরোধিতা করে। পার্লামেন্টারিয়ানরা মৃতপ্রায় 'States-General'-এর অধিবেশন আহ্বানের পরামর্শ দেন। রাজা বাধ্য হয়ে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে 'States-General'-এর অধিবেশন আহ্বান করেন।
'States-General' তিন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ছিল। জাতীয় মহাসংকটের সময় যখন ১৭৬ বছর পর এটি পুনরুজ্জীবিত হলো তখন শাসনতন্ত্রের প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল। এর সদস্যসংখ্যা ছিল ১,২১৪। যাজক সম্প্রদায় অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০৮, অভিজাত সম্পদায়ের ২৮৫ এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল ৬২১ জন, তন্মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী। সকল সদস্যের ভোটাধিকার ছিল না। সকল সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত ১টি করে মোট ৩টি ভোট ছিল। স্বার্থের খাতিরে ১ম ও ২য় সম্প্রদায় বা শ্রেণি সর্বদাই এক থাকত। তাই ৩য় সম্প্রদায় অধিবেশনের শুরুতে প্রত্যেককে ভোটাধিকার দেওয়ার দাবি জানায়। তৃতীয় সম্প্রদায় অর্থাৎ সাধারণ জনতার প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হবেন- এ আশঙ্কায় রাজা তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলেন। তারা তাদের দাবিতে অনড় রইলেন। অবশেষে তারা (১৭ই জুন ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) নিজেদের ফ্রান্সের National Assembly বলে ঘোষণা করলেন। তাদের যুক্তি ছিল, তারা ফরাসি জাতির ৯৬% জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং তারাই সমগ্র জাতির মুখপাত্র। মূলত এ সময় থেকেই ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়।
'রাজা যাজক ও অভিজাতদের প্ররোচনায় ৩য় সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য জাতীয় পরিষদের (National Assembly), অধিবেশন স্থগিত করলেন। ৩য় সম্প্রদায় ২০শে জুন তারিখে অধিবেশনের সময় এসে দেখে সভাগৃহ বন্ধ ও ফটকে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা 'মিরাবোর' নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হলো। এখানে তারা এ সম্পর্কে শপথ নেয় যে, যত দিন তারা ফ্রান্সের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করতে না পারবে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারবে তত দিন পর্যন্ত তারা সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ইতিহাসে তা 'টেনিস কোর্টের' শপথ নামে পরিচিত।
সভাপতি বেইলি বলেন, "তৃতীয় শ্রেণি হলো প্রকৃত জাতি, একে কারও আদেশ করার অধিকার নেই। " অতঃপর ষোড়শ লুই চিরাচরিত প্রথানুযায়ী অধিবেশন আহ্বান করেন এবং আলাদাভাবে ভোট প্রদানের কথা সকলকে জানিয়ে দেন। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১ম ও ২য় সম্প্রদায় অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করলেও ৩য় সম্প্রদায় সভাকক্ষে বসে রইল। তাদের কক্ষ ত্যাগের নির্দেশ দিলে 'মিরাবো' দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, "আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ স্থান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বলপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছুতে সম্ভব নয়।"" পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা ৩য় সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নিলেন এবং সকল সম্প্রদায়কে একই সভায় বসার ও প্রত্যেককে ১টি করে ভোট দেওয়ার অনুমতি দিলেন।
বিপ্লবের সূচনা
এ সময় ফ্রান্সে অজম্মার (খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া) ফলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। অসহায় কৃষককুল খাদ্যের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে প্যারিস নগরীতে সমবেত হতে লাগল।
সরকারি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেকে বিপ্লবের উন্মাদনায় খাদ্যের জন্য লুটপাট শুরু করল। প্যারিস নগরী 'বিপ্লবের মঞ্চে' পরিণত হলো। ভীত-সন্ত্রস্ত রাজা আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিচলিত হয়ে ভার্সাই নগরীতে সৈন্য মোতায়েন করলেন। কিছুদিন পর জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে বরখাস্ত করলেন। এতে বিপ্লবের বহ্নিশিখা তীব্রতর হলো। দেশের সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। জনসাধারণ সামন্তপ্রথার বিনাশকল্পে অভিজাতদের গৃহ আক্রমণ করে যাবতীয় মালামাল লুণ্ঠন করল। শুল্ক আদায়ের কুঠিগুলোতে আগুন দিল। এ ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি দেখে যাজক ও অভিজাত শ্রেণি নিজ নিজ অধিকার ত্যাগ করল। এভাবে সামন্তবাদের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত হওয়ায় 'সামাজিক সাম্য' স্থাপিত হলো। জনসাধারণ লাফায়েতের নেতৃত্বে দেশরক্ষার জন্য 'National Guard' নামে একটি জাতীয় বাহিনী গঠন করল। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুলাই উন্মত্ত ও বিপ্লবী জনতা অত্যাচারী শাসনের প্রতীক 'বাস্তিল দুর্গ' ধূলিসাৎ করে দিল। উন্মত্ত জনতা বন্দিগণকে মুক্ত করে বাস্তিলের গভর্নর দেলুনেকে হত্যা করল। রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও শোষণতন্ত্রের প্রাচীন প্রতীক দুর্গ 'বাস্তিলের' পতন ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ ঘটনা। এর পতনের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। বিদ্রোহ বিপ্লবের রূপ ধারণ করল। bsw
কৃষক-বিপ্লব
বাস্তিলের পতনের সংবাদ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে কৃষকদের মধ্যে তীব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শোষণের সকল যন্ত্র ভেঙে ফেলতে তারা চঞ্চল হয়ে ওঠে। সামন্ততান্ত্রিক শোষণ, পর পর শস্যহানি, বেকারত্ব ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গ্রামীণ কৃষককে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ যারা গ্রামাঞ্চলে বাস করত, তারা সামন্তপ্রথা ভাঙার জন্য কৃষকদের নেতৃত্ব দেয়। ইতিমধ্যে একটি গুজব ছড়াল যে, অভিজাতদের একদল ভাড়াটে গুণ্ডা গ্রামের শস্যক্ষেতগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং কৃষক-বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ফ্রান্সের সকল স্থানে ক্ষুব্ধ কৃষকদের দ্বারা জমিদারদের পল্লি ভবনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সামন্তপ্রথার বিনাশকল্পে জমিদার কুঠি ও শুল্ক আদায়ের কুঠিগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অনেক স্থানে কৃষকরা সামন্ত প্রভুদের জমিগুলো দখল করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়। তারা বেগার খাটতে ও কর দিতে অস্বীকার করে। শুধু জমিদারই নয়, কলকারখানার মালিকরাও হামলার শিকার হয়। প্রদেশসমূহে বিপ্লব সামাজিক অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এসব হামলা ও ভাঙচুরের সংবাদে যাজক ও অভিজাত প্রতিনিধিবর্গ ভীত হয়ে উঠলেন। ৪ঠা আগস্ট প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি নাটকীয়ভাবে নিজেদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বর্জন করতে শুরু করে। মাত্র এক রাতে কমপক্ষে ত্রিশটি আইন জারি করে মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলোর উচ্ছেদ সাধন করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এ রাত 'বঞ্চিতদের রাত' নামে খ্যাত।
বাস্তিল দুর্গ পতনের গুরুত্ব
বাস্তিল দুর্গের পতন ফ্রান্সের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ঐতিহাসিকদের মতে, এ পতনের প্রতীকী মূল্য ছিল ব্যাপক। দুর্গটি ছিল বুরবো শাসকদের ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক, অত্যাচারের প্রতীক। তাই বাস্তিল দুর্গ পতন মানে সনাতন সমাজব্যবস্থারই পতন। ফ্রান্সের সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে; পৌর বিপ্লবের পথ সুগম হয়। বাস্তিলের পতনের সাথে সাথে রাজতন্ত্রের সমর্থক সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে। রাজতন্ত্রের অবসানে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অচলাবস্থা দেখা দেয় এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ দুর্গ পতনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে জনসাধারণ প্যারিস নগরীতে বিপ্লবাত্মক কাজ শুরু করে। সৈন্যদের মধ্যে বিপ্লবের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক গুডউইন বলেন, "বিপ্লবের অন্য কোনো ঘটনা বাস্তিলের মতো বিভিন্নমুখী বা সুদূরপ্রসারী ছিল না।"
'বাস্তিল দুর্গ' পতনের কিছুদিন পরেই রাজা যোড়শ লুই নেকারকে পুনরায় মন্ত্রী নিয়োগ করলেন। কিন্তু বিপ্লবের গতিধারা ক্রমেই অদমনীয় হয়ে ওঠে এবং বেকার, দরিদ্র ও খাদ্যাভাবে পিষ্ট জনতা আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকে। ৫ই অক্টোবর কয়েক হাজার রমণী খাদ্যের দাবিতে 'ভুখা মিছিল' নিয়ে ভার্সাইয়ের দিকে যাত্রা করে। ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, "রাজা তার শেষ সমাধি রচনার জন্য এক রকম বন্দি অবস্থায় রানিসহ প্যারিস নগরীতে আসতে বাধ্য হলেন।" এ ঘটনাকে 'রাজতন্ত্রের শবযাত্রা' বলা হয়েছে। কিন্তু এত কিছু করা সত্ত্বেও রাজা জনসাধারণের ইচ্ছার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেন না। রাজতন্ত্রের সাথে জনতার ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। ফলে ফ্রান্সের ইতিহাস রক্তে রঞ্জিত হলো। এটা ছিল ফরাসি বিপ্লবের প্রথম অধ্যায়। ইতিমধ্যে বিপ্লবের কার্যে সহযোগিতার জন্য ফ্রান্সে বহু ক্লাব বা সংঘের উদ্ভব হলো। রাজপরিবার প্যারিসে আগমনের ফলে এখানে জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করা হয়; যার কাজ ছিল ফ্রান্সের জন্য নতুন সংবিধান বা শাসনতন্ত্র রচনা করা। ইতিহাসে তা 'ফরাসি গণপরিষদ' বা 'সংবিধান সভা' নামে পরিচিত।
বিপ্লবী সংস্কার ও সংবিধান সভা
ফরাসি বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সভা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এর কার্যাদির মধ্যে পূর্বতন আমলের সকল বৈষম্য, দুর্নীতি ও অনাচার ইত্যাদির বিলুপ্তির ঘোষণা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের স্থলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ ছিল।
ভার্সাই থেকে রাজপরিবারের প্যারিস নগরীতে আগমনের ফলে জাতীয় সভাকেও প্যারিসে অধিবেশন বসাতে হলো। তখন থেকে এই সভা ফ্রান্সের জন্য নতুন সংবিধান রচনা বা গঠনে মনোনিবেশ করে এবং স্বভাবতই তা ফরাসি সংবিধান সভায় পরিণত হয়। এর কার্যকাল ছিল ১৭৮৯-৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
সংবিধান সভা সামন্তপ্রথাজনিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলুপ্ত করে পুরাতন শাসনব্যবস্থার ত্রুটি দূর করেছিল। রুশোর গণতান্ত্রিক ভাবধারা, ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রভৃতির অনুকরণে ফরাসি গণপরিষদ মানুষের মৌলিক অধিকারসম্বলিত এক বিপ্লবী প্রস্তাবনাপত্র সন্নিবিষ্ট করেছিল। প্রস্তাবনাপত্রে বলা হয় যে-
১। স্বাধীনতা মানুষ মাত্রেরই জন্মগত অধিকার এবং প্রত্যেকে সমান মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।
২। ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পত্তি ভোগের স্বাধীনতা, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং অত্যাচারের বিরোধিতা করা মানুষের মৌলিক অধিকার।
৩। আইনের চোখে সকলেই সমান এবং বিনা বিচারে কাউকে কারারুদ্ধ করা চলবে না।
৪। ধর্মীয় ব্যাপারে স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ব্যক্তি মাত্রেরই আছে।
৫। জনগণই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র মালিক। এককথায় স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী তথা ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব ঘোষণা এই সনদে রূপলাভ করে। এই ঘোষণা সম্পর্কে ঐতিহাসিক আলার্ড (Aulurd) বলেন, "The declaration was a death certificate of the old Regime. "
অতঃপর সংবিধান সভা শাসনতন্ত্র রচনায় মনোনিবেশ করে এবং ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে চূড়ান্তভাবে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। নিম্নলিখিত শর্তাবলি এই সংবিধানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক।
১। প্রথমেই রাজার ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং রাজার খরচের জন্য Civil list প্রস্তুত করা হয়।
২। আইনসভার মতামত ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন করা অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
৩। রাজা নতুন আইন বাতিল করতে পারবেন না, কিন্তু সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার জন্য তাকে সাসপেনসিভ ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়।
৪। আইনসভা এক কক্ষযুক্ত হবে এবং এর সদস্যগণ জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। ভোটাধিকারের ব্যাপারে ফরাসি জনগণকে 'সক্রিয়' ও 'নিষ্ক্রিয়' নাগরিক- এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। কেবল সক্রিয় নাগরিকগণেরই ভোটাধিকার ছিল।
৫। সারা দেশকে ৮৩ ডিপার্টমেন্টে ভাগ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সকল ডিপার্টমেন্টের প্রধানগণ জনগণ কর্তৃক নিযুক্ত হবেন, কিন্তু তারা সভার সদস্য হতে পারবেন না।
৬। জাতির অর্থনৈতিক কাঠামোর নিরাপত্তা বিধান সংবিধান সভার পরবর্তী কাজ।
৭। পরবর্তী কাজ হলো ধর্মসংক্রান্ত। Civil Constitution of the Clergy নামের এক আইন দ্বারা প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে বা প্রদেশে একটি করে চার্চ স্থাপন করা হলো। সেসব চার্চের যাজকগণ জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন বলে স্থির করা হয়। ফলে যাজকগণ অন্যান্য কর্মচারীর ন্যায় মাসিক ভাতা পেতেন। এভাবে চার্চ রাষ্ট্রের অধীন হয়ে যায়।
৮। সর্বশেষ রোবস্পিয়ার নামের এক নেতার প্রস্তাব অনুসারে এই সংবিধান সভার কোনো সদস্য নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী গঠিত আইনসভার সভ্য হতে পারবেন না বলে স্থির করা হয়।
৯। বিনা বিচারে কাউকে কারারুদ্ধ রাখা আইনবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয় এবং 'লেত্রে ডি কেশে' (Lettre de Cachet) নামক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিলোপ করা হয়। স্থির হয়, বিচারকগণ সক্রিয় ভোটদাতাগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন এবং বিচারে জুরিপ্রথা প্রবর্তিত হয়। রাজা ও পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করা হয়।
এভাবে সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য এক নতুন শাসনব্যবস্থা উদ্ভাবন করে। পূর্বতন শাসনামলের অনেক দোষ-ত্রুটি দূরীভূত হলো এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হলো। কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত ও ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত সদস্যগণ সংস্কারগুলো এত দ্রুত প্রবর্তন করেন যে, এর ফলে জাতীয় ঐক্যের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে এবং সর্বত্র অরাজকতা ও অনিশ্চয়তার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। নতুন শাসনতন্ত্রে নানা ত্রুটি ছিল, এগুলো নিম্নরূপ:
শাসনতন্ত্রের রচয়িতাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল যে, তারা যে দ্রুতগতিতে পূর্বতন ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন করেছিলেন, সেই গতিতে পুনর্গঠনের কার্য সম্পন্ন করতে পারেননি। শাসনতন্ত্রের ত্রুটিসমূহ পর্যালোচনা করে আমরা দেখি যে, নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা অপ্রত্যাশিতভাবে খর্ব করা হয় এবং এর ফলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। শাসন বিভাগ ও আইন পরিষদকে এমনভাবে পৃথক করা হয় যে, রাজার মন্ত্রীগণ এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। রাজার প্রতি অত্যধিক সন্দেহ পোষণ করার ফলে শেষ পর্যন্ত নতুন শাসনব্যবস্থা বিফলতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এছাড়া সম্পত্তির মালিকানার উপর ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে বহু লোক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের দ্বারা স্বীকৃত সাম্যনীতি এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। এক কক্ষবিশিষ্ট 'আইন পরিষদ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগব্যবস্থা মোটেও সন্তোষজনক হয়নি। Civil Constitution of the Clergy প্রণয়ন করেই সংবিধান সভা সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল করেছিল। কারণ এতে চার্চের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে একে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অধীনে নিয়ে এসেছিল। এই বিধান প্রবর্তনের ফলে উচ্চ স্তর এবং অধস্তন উভয় শ্রেণির যাজক সম্প্রদায়ের মনে সন্দেহ ও ভীতির উদ্রেক করে এবং বিপ্লব সম্পর্কে ফরাসি জাতির মনোভাব-দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়। রোবম্পিয়ারের প্রস্তাব অনুসারে সংবিধান সভার কোনো সদস্য নতুন আইনসভার সদস্য হতে না পারার কারণে সেসব সদস্য যেটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা থেকে ফরাসি জাতি বঞ্চিত হয়। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক ছিল।
পরিশেষে মন্তব্য করা যায় যে, এসব দোষ-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলি একেবারেই ব্যর্থ হয়নি। ঐতিহাসিক ক্রপোটকিনের ভাষায়, "সংবিধান সভার কার্যাদি নিঃসন্দেহে মধ্যবিত্তের হলেও রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শ, অসমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহচিত মনোভাবের স্ফুরণের আদর্শ প্রভৃতি নতুন আদর্শের প্রবর্তন সংবিধান সভার মহান কৃতিত্বের পরিচায়ক।"২২ সামাজিক বৈষম্য দূর করে তা নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির সন্ধান দেয় এবং জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। তৎকালীন অসাম্য ও সুবিধা-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সাম্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজব্যবস্থার আংশিক গোড়াপত্তন করে। তাছাড়া সংবিধান সভা কর্তৃক প্রাদেশিক সুবিধা ও স্থানীয় ঐতিহ্যসমূহের বিলোপসাধন জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথ প্রশস্ত করে।
সন্ত্রাসের রাজত্ব
ফরাসি বিপ্লবের অগ্রগতির ইতিহাসে সন্ত্রাসের বা ত্রাসের রাজত্ব একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১০/১০/১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২৮/০৭/১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ফরাসি বিপ্লবের পরে বিপ্লববিরোধী মনোভাব, রাজতান্ত্রিকদের দমন ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে জাতীয় কনভেনশনের বামপন্থি উগ্র জেকোবিন দল যে জরুরি অবস্থাভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিপ্লবী আদর্শকে সংহত করতে তৎপর ছিল, তা-ই ইতিহাসের সন্ত্রাসের শাসন বা ত্রাসের রাজত্ব। এর প্রধান নেতা ছিলেন রোবস্পিয়ার। ত্রাসের রাজত্ব ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি আপৎকালীন জরুরি শাসনব্যবস্থা, যা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। তবে মানতে হবে যে, তৎকালীন সময়ে এর বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
সন্ত্রাসের রাজত্বের পটভূমি
জাতীয় কনভেনশনের সকল সদস্য একজোট হয়ে ফ্রান্সকে 'প্রজাতন্ত্র' বলে ঘোষণা করলেও তাদের মধ্যে মতৈক্যের চেয়ে মতানৈক্যই ছিল বেশি। তাই শুরু থেকেই জাতীয় কনভেনশনের কাজকর্ম অভ্যন্তরীণ সংহতির অভাবে ব্যাহত হয়। বিশেষত দেশের বাইরে-ভেতরে নানাবিধ সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে সংহতির অভাব জাতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আদর্শগত দিক দিয়ে গিরোন্ডিস্ট দল মনে করত, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ফ্রান্সের বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছে। জেকোবিন দল মনে করত, কেবল প্রজাতন্ত্র ঘোষণাতেই বিপ্লবের সুফল নিশ্চিত নয় বরং প্রজাতন্ত্রবিরোধী ও রাজতন্ত্রের সমর্থকদের শাস্তি দিয়ে বিপ্লবকে নিরাপদ করা প্রয়োজন। রাজা ষোড়শ লুইকে মৃত্যুদণ্ডে (২১শে জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে) দণ্ডিত করলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এক চরম শোচনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় উগ্রপন্থি জেকোবিন দলের সদস্যরা বিপ্লবকে বাঁচানোর জন্য এক স্বৈরাচারী নিষ্ঠুর শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। বিপ্লবী নেতা মারাট এ ব্যবস্থাকে 'মুক্তির স্বৈরতন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। আসলে এ ব্যবস্থা ছিল ভীতি ও বলপ্রয়োগ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিপ্লবকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার এক অভিনব পদ্ধতি।
এককথায় বলা যায়, রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং উদ্দেশ্যসাধনে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আর এ ঐক্য অর্জন ভীতি প্রদর্শনের দ্বারাই সম্ভব। এ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়েই তারা ফ্রান্সে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।'
তিনটি কারণে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছিল-
প্রথমত: বিপ্লবীদের হাতে ষোড়শ লুইয়ের প্রাণনাশে সারা ইউরোপে স্বৈরাচারী শাসকগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, তাদের নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে চরমপন্থার অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত: জাতীয় কনভেনশনের বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের সম্প্রসারণনীতি ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে বিপ্লববিরোধী হয়ে ওঠে। তাই ইউরোপীয় শক্তিসমূহ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে আক্রমণে উদ্যত হয়। বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াও ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিপ্লববিরোধী হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে রাজতন্ত্রের সমর্থকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। প্যারিস কমিউনের একাধিপত্য ও প্রাধান্য অন্যান্য শহরবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। রাজনৈতিক অসন্তোষের সাথে ধর্মীয় বিবাদ যুক্ত হয়ে এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এসব কারণে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে জেকোবিন দল বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য এ ব্যবস্থা কায়েম করতে বাধ্য হয়। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকে জোরদার করে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, বিপ্লববিরোধীদের শাস্তি বিধান করা এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করা।
সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা
উপর্যুক্ত পটভূমিকায় দেশে একটি শক্তিশালী সর সরকার প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ফ্রান্সের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১২ জন সদস্য নিয়ে রোবম্পিয়ারের নেতৃত্বে 'জননিরাপত্তা কমিটি' গঠন করা হয়। এই কমিটিকে সহায়তা করার জন্য তিনটি সংস্থা গঠন করা হয়- সন্দেহ আইন, বিপ্লবী বিচারালয় ও বিপ্লবী বধ্যভূমি। জননিরাপত্তা কমিটিকে সহায়তাদানের জন্য বিরাট সেনাবাহিনী গঠিত হয়।
সন্দেহ আইনের বলে যেকোনো ব্যক্তিকে রাজতন্ত্রের সমর্থক বা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী বলে সন্দেহ হলে গ্রেফতার করা যেত। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতারের জন্য সমগ্র ফ্রান্সে ৫০,০০০ বিপ্লবী কমিটি গঠন করা হয়।
বিপ্লববিরোধী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য এক বিশেষ বিপ্লবী বিচারালয় গঠিত হয়। এটি স্থাপিত হয় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে। এটি ছিল বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত এবং এর রায় চূড়ান্ত বলে গৃহীত হতো। বিপ্লবী বিচারালয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর করা হতো।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে বিপ্লবী বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো এবং গিলোটিনের আঘাতে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। মৃত ব্যক্তির সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। একমাত্র প্যারিসের বিচারালয়ের রায়ে এক হাজারের অধিক নর-নারীকে গিলোটিনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল।
ত্রাসের রাজত্বের ফল
ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ফ্রান্সের অবস্থার উন্নতি হয়। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের উল্লেখযোগ্য উন্নতির মূলে ছিল সন্ত্রাসের শাসনের সাফল্য। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিপ্লববিরোধী সকল শক্তিকে দমন করে ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। ঐতিহাসিক ওলার বলেন, "সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল পরিস্থিতির চাপে উদ্ভূত স্বৈরশাসন ব্যবস্থা।"** ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, "ত্রাস-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা বাস্তবধর্মী রাজনীতি জ্ঞানের একটি বিস্ময়কর অবদান। এটি ফ্রান্সকে বিপদমুক্ত করেছিল।" সন্ত্রাসের শাসন যে এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব শাসনব্যবস্থা ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফ্রান্সের সংকটময় মুহূর্তে এ রকম শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য 'জরুরিকালীন স্বেচ্ছাতন্ত্র' এবং 'ক্লেশ স্বেচ্ছাতন্ত্রের' প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সংকটময় পরিস্থিতিতে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে ও বৈদেশিক আক্রমণে ফ্রান্স খণ্ড খণ্ড হয়ে যেত। অনেকের কাছে সন্ত্রাসের রাজত্ব অসহ্য মনে হয়েছিল। ফলে বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে রোবস্পিয়ারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে এবং তার বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়। আকস্মিকভাবে একদিন সকলে মিলে রোবস্পিয়ার ও তার অনুগামীদের গিলোটিনে হত্যা করলে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।
ফরাসি কয়েকজন নেতা
মিরাবো (Mirabeau): ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম জননেতা মিরাবো এক অভিজাত পরিবারে ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল ও অমিতব্যয়ী ছিলেন। তিনি একপ্রকার সমাজচ্যুত হয়ে তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগদান করেন এবং বিপ্লবে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে ফ্রান্সের জাতীয় সভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনকালে তিনি সদন্তে ঘোষণা করেছিলেন, "আমি একটা খ্যাপা কুকুর। কিন্তু আমাকে আপনারা নির্বাচিত করুন; দেখবেন আমার কামড়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও সুবিধাবাদের অপমৃত্যু হয়েছে।" বিপ্লবকালীন টেনিস কোর্টের শপথে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। তিনি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন না কিন্তু রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের দোষ-ত্রুটি দূর করতে চেয়েছিলেন। এজন্য রাজা ষোড়শ লুইকে তিনি শাসনতান্ত্রিক পথে বিপ্লব পরিচালনা করতে বলেছিলেন। ষোড়শ লুইয়ের উপদেষ্টা হিসেবে তিনি রাজাকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অবিবেচক রাজা তার উপদেশ গ্রহণ করেননি। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হলে ফরাসি রাজতন্ত্রের সকল আশার অবসান ঘটে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বিপ্লব এত সর্বগ্রাসী হয়ে ধ্বংসলীলার সূত্রপাত করতে পারত না। তার উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি বিপ্লবকে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করা।
ডানটন: ডানটন ছিলেন একজন আইনজীবী এবং জেকোবিন দলের বিপ্লবী নেতা। গ্রান্ট এবং টেমপারলের মতে, "বিপ্লবের ইতিহাসে ডানটন একটি অদ্ভুত চরিত্র।" ফ্রান্সের বিপ্লবের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। তার কর্মকুশলতায় ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স প্রুশিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। তিনি জেকোবিন গিরোন্ডিস্টদের মধ্যে বিভেদ তুলে দিয়ে ফ্রান্সের মঙ্গলার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ত্রাসের রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হোক এটা তার কাম্য ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি উগ্রতা পছন্দ করতেন না। জেকোবিন দলের উগ্রপন্থি নেতা রোবম্পিয়ারের সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং গিলোটিনের দ্বারা মৃত্যু কার্যকর করা হয়। তার মৃত্যুর পর রোবম্পিয়ারের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে।
রোবম্পিয়ার: ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ছিলেন রোবস্পিয়ার। তিনি ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি ছিলেন আইনজীবী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত উগ্রপন্থি। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ব্যক্তি চরিত্রের সংকীর্ণতা, একদেশদর্শিতা ও উচ্চাভিলাষ একদিকে তাকে যেমন হেয়প্রতিপন্ন করেছিল, তেমনি সত্যনিষ্ঠা ও নীতিজ্ঞানের জন্য সমসাময়িক বিপ্লবীদের মধ্যে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিল। তিনি সদ্গুণ ও বিভীষিকাকে শাসনকার্যের হাতিয়ার বলে মনে করতেন। তার ব্যক্তিগত চরিত্রে একদিকে ছিল উদার রূপ, অন্যদিকে ছিল নিষ্ঠুরতা। ডানটন ও হার্বার্টের মৃত্যুর পর জেকোবিন দলের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। রাজতন্ত্র অবসানের পর তিনি ফ্রান্সে বিভীষিকার রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ছিলেন। তার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় বহু লোকের মৃত্যু ঘটেছিল; তবে তিনি বিভীষিকার পথ ধরেই বিপ্লবকে রক্ষা করেছিলেন। ক্ষমতার অন্ধমোহ তার জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুলাই তিনি অনুচরবর্গসহ এক হোটেলে প্রতিবিপ্লবীদের হাতে ধৃত হন এবং তাকে ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুলাই গিলোটিনে হত্যার মধ্য দিয়ে ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।
লাফায়েত (Lafayette): লাফায়েত ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের এক গর্বিত সৈনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, জনস্বার্থ বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বিধান করা প্রত্যেক শাসনব্যবস্থারই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন নির্ভীক ও উদারচেতা। মানবাধিকারের মহান দলিলে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও শাসনকার্য-নির্বাহক কমিটির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। নেপোলিয়নের মতে, তিনি ছিলেন নির্বোধ ও বিপ্লবী নেতা। মিরাবোর মতে, তিনি ছিলেন প্রধান বিদূষক, ডেনিস রিচার্ডের মতে, তিনি ছিলেন সাহসী, নিষ্ঠাবান, যুদ্ধপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও নির্বোধ।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

