- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ফরাসি বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক কারণ
পূর্বতন শাসনামলে ফ্রান্সের জনসমাজ প্রধানত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যথা- সুবিধাভোগী শ্রেণি ও সুবিধাহীন শ্রেণি। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় প্রথম দলভুক্ত ছিলেন। যাজকগণকে প্রথম সম্প্রদায় এবং অভিজাতগণকে দ্বিতীয় সম্প্রদায় বলা হতো। সমাজে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত, শ্রমশিল্পী, কৃষক প্রমুখ শ্রেণি ছিল সুবিধাহীন সম্প্রদায়ভুক্ত। সুবিধাহীন শ্রেণিকে আবার অধিকারহীনও বলা হয়। কারণ এসব শ্রেণির মানুষের কোনো অধিকার ছিল না, ছিল কেবল দায়িত্ব পালনের তাগিদ। অপরদিকে সুবিধাভোগী শ্রেণির যাজক ও অভিজাতগণ কেবল ভোগ করতেন। কর না দেওয়ার সুবিধা, অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়া, এককথায় কোনো দায়িত্ব পালন না করেই শুধু সুবিধা ভোগ করাই ছিল তাদের অধিকার। ফরাসি সমাজের নিয়মটা যেন ছিল এ রকম- যাজকরা উপাসনা করবেন, অভিজাতরা লড়াই করবে আর বাকি সবাই জোগাবে তাদের জন্য অর্থ। ফরাসি সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ও অধিকারহীন মানুষের মধ্যে যে বিস্তর প্রভেদ ছিল, তাকে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়।
পূর্বতন শাসনামলে ফ্রান্সে রাজাকে বাদ দিলে যাজকদের ছিল সমাজের সর্বোচ্চ আসন। এজন্য ফ্রান্সে যাজক শ্রেণিকে বলা হতো প্রথম এস্টেট বা প্রথম সম্প্রদায়। ধর্ম-উপাসনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, সাধারণ মানুষের ন্যায় যাজক শ্রেণি পার্থিব ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো সম্পর্কেও আগ্রহী ছিল। তারা খুব জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করতেন এবং ধর্ম কর আদায় করতেন। তবে যাজক শ্রেণির মধ্যে নিম্নস্তরের যাজকরা আবার উপরের স্তরের যাজকদের ঘৃণার পাত্র ছিলেন। উচ্চ ও নিম্নস্তরের মধ্যে যে সামাজিক প্রভেদ ছিল, তা নিম্নশ্রেণির যাজকদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন কামনা করতেন।
যাজকদের পরেই ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের স্থান। তাদের বলা হতো দ্বিতীয় এস্টেট বা দ্বিতীয় সম্প্রদায়। প্রথা হিসেবে সামন্তবাদ বিলুপ্ত হলেও অভিজাত শ্রেণির সামন্তপ্রথা থেকে পাওয়া সুবিধাসমূহ আগের মতো বহাল ছিল। সমাজের প্রতি দায়িত্বহীন অভিজাতরা যাজক ব্যতীত আর সকলের উপার্জনের উপর বেঁচে থাকত বলে তারা ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিল। বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ অভিজাতদের এসব সুবিধা নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর হয়। দেশের প্রায় সমস্ত জমি বিনা খাজনায় অভিজাত ও ঊর্ধ্বতন যাজকরা ভোগ করতেন। তাদের এ স্বার্থপরতা তৃতীয় সম্প্রদায়ের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল বঞ্চিত ও নিপীড়িত। তারা আবার তিনটি উপদলে বিভক্ত ছিল, যথা- ১. বুর্জোয়া ২. কারিগর ও ৩. কৃষক। বুর্জোয়ারা ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, ধনসম্পদ ও জাতীয়তাবোধে অন্যান্য শ্রেণির ঊর্ধ্বে। তারা অভিজাতদের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফরাসি দার্শনিকদের ক্ষুরধার লেখনী তাদের মনের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করে, তারা প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের মতো সমান অধিকার দাবি করে এবং বিপ্লব ঘটানোর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অপরপক্ষে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিও তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করতে সম্মত ছিল না। বুর্জোয়াদের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং সুবিধাপ্রাপ্তদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আপসহীন মনোভাব- এই মানসিক অবস্থা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন, সামাজিক অহমিকাই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ, স্বাধীনতা ছিল অজুহাত মাত্র। বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এবং সাধারণ মানুষ তাদের দয়ার উপর নির্ভর করত। কারিগর ও শ্রমশিল্পীরা স্বভাবতই সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমেই বিপ্লবী হয়ে ওঠে। কৃষকদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। নানা প্রকার কর প্রদানের দায়িত্ব শুধু তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। তাছাড়া জমিদারের কাজে তারা বেগার খাটত এবং শ্রম কর দিতে বাধ্য ছিল। সামন্তপ্রথাজনিত নানাবিধ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কৃষকরা একে অবৈধ ও অসংগত বলে বিবেচনা করত। কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। বিপ্লবের প্রাক্কালে মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মৌলিক নাগরিক অধিকার ছিল না। অধ্যাপক মন্টেস্কু বলেন, "কৃষকদের দুরবস্থাই ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণ। সুতরাং সামাজিক বৈষম্যপ্রসূত বিদ্বেষ ফরাসি বিপ্লবের একটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ।"
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

