- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি || Islamic Education and Culture
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি || Islamic Education and Culture
শিক্ষায় মুসলিম মনীষীদের অবদান- Contributions of Muslim Scholars in Education
মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির যথাযথ উন্মেষ ও বিকাশে মুসলিম জাতির অবদান অবিস্মরণীয়। ইসলাম জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষাগ্রহণকে ফরজ করে দিয়ে শিক্ষা ও জ্ঞাননির্ভর যে ধারার সূচনা করেছে তারই ধারাবাহিকতায় মুসলিম মনীষীরা গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁদের অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। যে জন্য আধুনিক বিজ্ঞান কেবল চমকপ্রদ আবিষ্কার ও কালোত্তীর্ণ তত্ত্বের জন্যই মুসলিমদের কাছে ঋণী নয়, বরং আধুনিক বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের জন্যও মুসলিম মনীষীদের কাছে চিরঋণী।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ভূমিকা
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স) অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না, কিন্তু মহাজ্ঞানী ছিলেন। তিনি কারো কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তাঁর একমাত্র শিক্ষক হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসুলকে (স) সব বিষয়ের জ্ঞানদান করেছেন। সে জন্য রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। নবুয়ত লাভের তিন বছরের মধ্যেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এ সময়ে মক্কার পরিবেশ পুরোপুরি ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল। মুসলিমদের কোনো রকমের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। সাধারণত গরিব শ্রেণির লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল বলে মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না।
এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরকম একটি বৈরী পরিবেশে রাসুলুল্লাহ (স) দারুল আরকাম' নামে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কার সাফা পাহাড়ের পাদদেশে সাহাবি হযরত আরকাম (রা) এর বাড়িতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দারুল আরকামের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসুল (স)। তিনি সেখানে মুসলিমদের প্রয়োজনীয় হুকুম-আহকাম শেখাতেন। রাসুলুল্লাহ (স)-এর নিজের বাসগৃহটিও বিদ্যালয়ের রূপ লাভ করেছিল। সবার জন্য এবং সবসময় এ বাড়ির দরজা উন্মুক্ত ছিল।
রাসুলুল্লাহ (স)-এর সাথে উম্মুল মুমিনীনগণও শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যে জন্য রাসুলের (স) ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালমা প্রমুখ নবিপত্নীর উদ্যোগে নবিগৃহ নারী শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বদর যুদ্ধে বন্দি মুশরিকদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করে রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে একটি অভিনব উদ্যোগ নেন । তিনি প্রতিজন শিক্ষিত বন্দিকে তিনজন মুসলমানকে জ্ঞানদান করার শর্তে মুক্তি প্রদান করেন।
মদিনার মসজিদে নববির নির্মাণ সমাপ্ত হলে শিক্ষাবিস্তারে রাসুলুল্লাহ (স) অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তিনি মসজিদের বারান্দায় একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষার্থীরা সবসময় অবস্থান করে রাসুলুল্লাহ (স) এর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। এ বিদ্যালয়টি ‘সুফফা' এবং এর শিক্ষার্থীরা ‘আহলি সুফফা' নামে পরিচিত। মসজিদে নববিতে মহানবি (স) নিজে বিভিন্ন শিক্ষার আসর পরিচালনা করতেন। সাধারণভাবে তিনি শিক্ষাগ্রহণ ও প্রদানের জন্য ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। যার ফলে একটি অশিক্ষিত জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিত জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদার ভূমিকা
রাসুল (স) প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার বুনিয়াদ খোলাফায়ে রাশেদার সময়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করে। খোলাফায়ে রাশেদার চার সদস্য যথাক্রমে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রা) শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাদের সবাই মসজিদে নববিকে প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি খিলাফতের অধীন সব মসজিদকে শিক্ষালয়ে পরিণত করেন। হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে পবিত্র কুরআন মাজিদের গ্রন্থাবদ্ধ সংকলন সম্পন্ন হয়।
হযরত উসমান (রা) এ সংকলনে পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষাবিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। হযরত উমর (রা) প্রথম শিক্ষাবিস্তারের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি খিলাফতের বিভিন্ন এলাকায় মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে বায়তুল মাল থেকে বেতনভুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করেন। যাযাবর বেদুইনদের শিক্ষিত করার জন্যও উমর (রা) বিশেষ উদ্যোগ নেন।
তিনি তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করেন এবং কেউ কমপক্ষে কুরআন তিলাওয়াত করতে না পারলে তার জন্য শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেন। হযরত উসমান ও আলী (রা) এ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। হযরত আলী (রা) অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কারণে রাসুল (স) এর কাছ থেকে 'জ্ঞানের দ্বার' উপাধি লাভ করেন। তাঁদের সদিচ্ছায় মুসলিম খিলাফতে শিক্ষাদান ও গ্রহণে বিপুল গতি সঞ্চার হয়।
উমাইয়া খলিফাদের ভূমিকা
হযরত মুআবিয়া (রা) ইসলামি গণতন্ত্র ও খিলাফতের অবসানের পর রাজতন্ত্র চালু করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ‘উমাইয়া রাজবংশ' হিসেবে পরিচিত। শিক্ষাবিস্তারে এ বংশটির ভূমিকাও কম নয়। উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজ রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদিস সংকলনের উদ্যোগ নেন। এ সময়ে দামেস্ক, কুফা, বসরা, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি অঞ্চলে কুরআন-হাদিসের অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় হাকাম ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতে প্রতিষ্ঠা করেন 'কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়'। আজও পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখছে।
উমাইয়া খলিফাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম মনীষীদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, চিকিৎসা, গণিত, নৌচালনা প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রীয়জ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত হয়। এ সময়ে ইসলামি আইনবিজ্ঞান বা ফিকহশাস্ত্রের ওপরও বিচ্ছিন্ন ধারার কাজ শুরু হয় যা পরে সুসংঘবদ্ধ রূপলাভ করে ।
আব্বাসীয় খলিফাদের ভূমিকা
মুসলিম জাতির শিক্ষাবিস্তারের স্বর্ণযুগ নির্মাতা হলো আব্বাসীয় রাজবংশ। আব্বাসীয় খলিফাগণ রাজ্য জয়ের চেয়ে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা বিস্তারে বেশি মনোযোগ দেন। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক অধ্যায় সূচিত হয়। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর প্রথম শিক্ষাবিস্তারে খিলাফতকে সম্পৃক্ত করেন। তার সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্রিক ও সংস্কৃত পুস্তকের আরবি অনুবাদ শুরু হয়। পরবর্তী খলিফা হারুন অর রশীদ এ ধারার পূর্ণতা সাধন করেন। এ ক্ষেত্রে খলিফা আল-মামুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বাগদাদে 'বায়তুল হিকমাহ' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটি বিভিন্ন বিভাগে বিন্যস্ত ছিল।
পাঠাগার, গবেষণা, অনুবাদ, মানমন্দির ও শিক্ষাদান বিভাগ নিয়ে বায়তুল হিকমাহ' গড়ে উঠেছিল। এটি ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। আব্বাসীয় খলিফাগণ শিক্ষাবিস্তারের কাজ সুলভ ও সহজ করার জন্য বাগদাদে কাগজের কল স্থাপন করেন। তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত অধ্যাপক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করেন। সরকারি বেতনভুক্ত হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল । শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলার জন্য আব্বাসীয় খলিফাগণই প্রথম মসজিদভিত্তিক পাঠাগার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হালাকুখানের হাতে ধ্বংসের আগপর্যন্ত বাগদাদ ছিল শিক্ষাবিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার রাজধানী।
ইউরোপে শিক্ষা বিস্তারে মুসলমানদের অবদান
৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের মাধ্যমে ইউরোপে ইসলামের প্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে এটিই সারা বিশ্বের শিক্ষা, শিল্প- সভ্যতা ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ও ইতালি থেকে আগত শিক্ষার্থীরা কর্ডোভা, সেভিল, টলেডো, জেইন ও মালাগার উচ্চশিক্ষায়তনগুলোতে ভিড় জমাতে থাকে। স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের আল-আজহার ও ইরাকের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও উন্নত ছিল।
কুরআন, আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে স্পেনে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতো। উচ্চশিক্ষার মধ্যে তাফসির, ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ, অভিধান শাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হতো। স্পেনের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপুল উন্নতি বোঝা যায় সেখানকার শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারের বইয়ের সংগ্রহ দেখে ।
জেনে রাখো:
'বায়তুল হিকমাহ' হলো একটি বিজ্ঞানাগার বা গবেষণাগার। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদ, (বর্তমানে ইরাকের রাজধানী) নগরীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। 'বায়তুল হিকমা' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিমদের বিজ্ঞানচর্চায় এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এটি মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল ও চিকিৎসাবিদ্যাসহ আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানটির অবদান অনস্বীকার্য।
একক কাজ: শিক্ষায় মুসলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কে একটি তালিকা তৈরি করো ।