• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • অনার্স
  • আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থ-সামাজিক পটভূমি বর্ণনা কর।

ভূমিকা: এই অনন্ত অসীম বিশ্বচরাচরের সব কিছুই যেন পরিবর্তনশীলতার চক্রে সর্বদা নতুনের পদধ্বনিতে মুখরিত। এই পরিবর্তনের ঢেউ মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণায়
প্রভাব বিস্তার করে একে অধিক গতিশীল করে তোলে। এই গতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রভাবে সামাজিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ এ তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এর পটভূমি ও বিকাশ ধারা।

আর্থ-সামাজিক পটভূমি: নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. রেনেসাঁর প্রভাব যে শক্তি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে রূপদানে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে তার মধ্যে রেনেসাঁ হচ্ছে অন্যতম। ষোল শতকে রেনেসাঁর মানসপুত্র ম্যাকিয়াভেলী মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তাকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে আলাদা করেন এবং নতুনভাবে রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যা দান করেন। মূলত রেনেসাঁই রাজনীতিকে নতুন প্রাণ দান করেছে। রেনেসাঁ কথাটির অর্থ হচ্ছে জাগরণ। সমাজের সর্বক্ষেত্রে কোনো বিজ্ঞানধর্মীয় জাগরণকেই মূলত রেনেসাঁ বুঝায়। রেনেসাঁর জন্ম ইতালিতে। এটি মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা ভেঙ্গে দিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে মানুষকে জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা দান করে। রেনেসাঁ সম্পর্কে অধ্যাপক মেয়ার বলেন, "রেনেসাঁ হচ্ছে নতুন আদর্শের প্রচারণা যা পুরোপুরিভাবে মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে নতুন পৃথিবীর পত্তন ঘটায়।"

২. ধর্ম সংস্কার আন্দোলন য়ে আন্দোলন রাষ্ট্রশক্তি বৃদ্ধি করতে ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্ম ও গণতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলেছিল তা হচ্ছে রেনেসাঁর ধর্মসংস্কার আন্দোলন। রেনেসাঁর মাধ্যমে মানুষ যখন জাতির জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তখন তারা ধর্মীয় অনাসৃষ্টির এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই আন্দোলনের নাম Reformation বা সংস্কার আন্দোলন। সংস্কার আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক গেটেল বলেন, "The immediate effect of the reformation was to strength than the authority of the state; the ultimate effect was further individual liberty and democracy."

৩. বিজ্ঞানের আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে মানুষের মনে নব নব চিন্তার উন্মেষ হতে থাকে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ও ভাস্কো-দা-গামা কর্তৃক ভারতীয় জনপদ আবিষ্কার ইত্যাদি একদিকে যেমন মানব সভ্যতার দিগন্তকে উন্মোচিত করে অন্যদিকে পুরাতন জীবনযাত্রা থেকে উন্নততর জীবনযাত্রার দিকে ঝুঁকে পড়ে। জনপদ আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ভৌগোলিক আবিষ্কারের সাথে সাথে নব নব সভ্যতা গড়ে ওঠে। নিউটন, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস প্রমুখ বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে আরো বিকশিত করে।

৪. লোকায়ত চিন্তা-চেতনা সপ্তদশ শক্তির পরে লোকায়ত চিন্তা-চেতনা রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় স্বধারা থেকে বেরিয়ে আসে। বস্তুত, লোকায়ত ভাবধারার প্রসারের কারণেই রেনেসাঁর আন্দোলনের পরে রাজনীতি আর ধর্মীয় চিন্তার বন্ধনে আবন্ধ না থেকে আলাদা হয়ে পড়ে এবং চার্চের প্রভাব বলয় হতে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে লোকায়তবাদী আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। শিক্ষাকে ধর্মের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যার শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়।

৫. জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা: জাতীয় রাষ্ট্র ও সার্বভৌম ধারণার পর থেকে রাষ্ট্রচিন্তা মধ্যযুগীয় বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মধ্যযুগীয় ব্যক্তির জন্য ধর্ম অপরিহার্য ধারণার বদলে ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জন্ম নেয় প্রাকৃতিক অধিকার, সামাজিক চুক্তি, ক্ষমতার বিভাজন ইত্যাদি ধারণার। ব্যক্তির নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্যে চরম রাজতন্ত্র ও জাতীয় রাষ্ট্র এবং সার্বভৌম তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। আর এ সার্বভৌম ধারণার রাষ্ট্রচিন্তাকে আধুনিক যুগে রূপায়িত করে।

৬. ব্যক্তি স্বাধীনতার উন্মেষ ক্রমে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভাবধারার উন্মেষ ঘটতে থাকে। মানুষ ব্যাপকভাবে সচেতন হতে থাকে। ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নের প্রেক্ষিতে মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণের পক্ষে সচেতনতা ধর্মের অলৌকিক নির্দেশের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কুঠারাঘাত হানে। ক্রমেই মানুষের মধ্যে সাম্য ও গণতন্ত্রের আদর্শ দানা বেঁধে ওঠে।

৭. ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশধারায় ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বাণী অত্যন্ত কার্যকর প্রভাব ফেলেছে এতে সন্দেহ নেই। রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকগণ ফরাসি বিপ্লবের প্রবক্তা হিসেবে আধুনিককালের রাষ্ট্রদর্শনের ধারায় নতুন দিগন্তের উন্মেচন করেছেন।

৮. শক্তিশালী রাজতন্ত্র: মধ্যযুগের শেষের দিকে এবং আধুনিক যুগের প্রারম্ভে এশিয়া, ইউরোপ, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে এবং মানুষের চিন্তাধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ফলে মধ্যযুগীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত হানে। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে চার্চের আইনগত ক্ষমতা রহিত হয়।

৯. পুঁজিবাদী ধারণার বিকাশ উদারতাবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার ফলশ্রুতিতে সামন্তবাদী সমাজ ভেঙ্গে যেতে থাকে এবং পুঁজিবাদী সমাজ গঠিত হতে থাকে। উভয় মতবাদের নিয়ন্ত্রণহীন মুক্ত হওয়ার প্রভাব সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় যা পুঁজিবাদ নামে পরিচিত। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সূত্রপাত ঘটাতে সাহায্য করে।

১০. আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম: অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় জাতিকে এগিয়ে নেয়। মধ্যযুগের পর রাজতন্ত্রের যে প্রাধান্য সৃষ্টি হয় কালক্রমে তা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইত্যালি ও রাশিয়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চরম পর্যায়ে পৌছে এবং তা স্বৈরতন্ত্রের রূপ ধারণ করে। এসব চরম স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ আত্মসচেতন হয়ে ওঠে ও বিদ্রোহের বহ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে। যেমন- ১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলে সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়ে। এ স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।

১১. উদারতাবাদ : উদারতাবাদ থেকেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম। ব্যক্তি যখন নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় রাষ্ট্র কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তখন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বাকস্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করে। স্পেনসার, বেস্থাম প্রমুখ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা এবং জে. এস. মিলকে এ তত্ত্বের জনক বলা হয়। বস্তুত উদারতাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

১২. উপযোগবাদ: ফরাসি বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক চিন্তার সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তাধারা হচ্ছে উপযোগবাদ। যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে কার্যকর প্রভাব রেখেছে।

১৩. বিখ্যাত মনীষীদের অবদান সর্বোপরি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে বিশ্বের বিভিন্ন দার্শনিকগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হবস্, লক, রুশো, মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, কার্ল মার্কস, হেগেল, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখ দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও লেখনী শক্তি গোটা বিশ্বে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে অত্যন্ত গৌরবময় ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটেছে ধারাবাহিকতার উপর ভিত্তি করে। মধ্যযুগীয় অযৌক্তিক চিন্তা-চেতনা মানুষের মনে যে অনাস্থার জন্ম দিয়েছিল ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রতি বিদ্রোহ প্রদর্শনের উপায় হিসেবে বিভিন্ন কার্যকর ভাবধারা ও শক্তির প্রভাবে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম। পরিশেষে একথা বলা যায় যে, যন্ত্রযুগ ও প্রযুক্তিবিদ্যার উৎকর্ষতার কারণে মানুষের চিন্তাধারাতেও পরিবর্তন হচ্ছে, হয়তো তাই বর্তমানে আমরা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে অবস্থান করছি, একই কারণে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো কি হবে বলা মুশকিল।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ