• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • অনার্স
  • আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি

নাৎসিবাদ বলতে কি বোঝ? জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণসমূহ আলোচনা কর।

নাৎসি জার্মানি এবং তৃতীয় রাইথ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে জার্মানির প্রচলিত নাম। এ সময়ে জার্মান সরকার একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি বা নাৎসি পার্টির অধীনে ছিল যার কেন্দ্র ফিউরবে হিসেবে ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। হিটালারে অধীনে জার্মানি একটি আধিপত্যবাদী ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তৃতীয় রাইসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের মানবতা বিরোধী ভূমিকার জন্য দেশে ও বিদেশে বিতর্কিত হয়েছিল।

নাৎসিবাদ জাতীয় সমাজতন্ত্র বা সাধারণত নাৎসিবাদ নামে পরিচিত একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা বিংশ শতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে উদ্ভূত নাৎসি পার্টির সাথে সম্পর্কিত। এটাকে সাধারণত এক ধরনের ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌলিবাদ, ইহুদিক্লিয়ে অন্তর্ভুক্ত। অ্যাডলফ হিটলারকে ন্যাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নাৎসিবাদ হচ্ছে হিটলার ও তার দল নাৎসি পার্টি কর্তৃক শাসনব্যবস্থা।

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রার্থী হয়ে হিনভেনবার্গের কাছে হিটলার পরাজিত হন। ১৯৩৩ সালে হিনডেনবার্গ হিটলারকে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। কিছুদিনের মধ্যেই হিটলার সকল ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে দেশে নাৎসি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে জার্মানিতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে হিটলার ও তাঁর নাৎসিদল জার্মানির শাসক দলের মর্যাদার অধিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গ্রেফতার অপহরণ, নির্বাসন ও গোপন হত্যার মাধ্যমে জার্মানির কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের নির্মমভাবে দমন করে হিটলার তাঁর নাৎসি দলের সাহায্যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দখল করে নেন।

অতঃপর নাৎসি পার্টি জার্মানিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং হিটলার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক নাৎসি শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণসমূহ: হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিবাদ উত্থানের কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. জার্মান জাতিকে রক্ষা: হিটলারের মতে, জার্মান জাতি হচ্ছে বিধাতার একমাত্র মনোনীত জাতি এবং বিশ্বকে শাসন করার মহান দায়িত্ব দিয়েই বিধাতা তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন এবং জার্মান জাতির পবিত্রতা রক্ষা করাকেই হিটলার তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে গণ্য করেন এবং জার্মান জাতির পবিত্রতা, অখণ্ডতা ও বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য তিনি দুটি সুস্পষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

প্রথমত, জার্মান মিশ্রণ থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি ইহুদিদেরকে নিঃশেষে ধ্বংস করার কথা ঘোষণা করেন।

দ্বিতীয়ত, জার্মান জাতির স্বাস্থ্য, শৌর্য ও মানসিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সুপ্রজনন পদ্ধতি চালু করেন। এসকল কাজগুলো করার জন্য হিটলারের নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে।

২. অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মানির অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জার্মানিতে ভাইসার প্রজাতান্ত্রিক সরকারের দুর্বলতা নানা দিক দিয়ে ফুটে বেরুতে থাকে। দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, শিল্প বাণিজ্য মন্দা, জনস্ফীতি, খাদ্য সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি নানান সমস্যার কারণে মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয় ওঠে ও ভার্সাই সন্ধি অপমানজনক শর্তগুলো জার্মানদের মধ্যে গভীর উত্তেজনা ও প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তোলে, তখন ইটালির অনুকরণে জার্মানিতেও নাৎসি নামক এক শক্তিশালী দলের উদ্ভব হয়।

৩. জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: ফ্রামিস্টদের মতো নাৎসিরাও ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। দেশে জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নাৎসিদের উদ্দেশ্য ইটালির মতো যুদ্ধবিদ্ধস্ত জার্মানিতেও সর্বক্ষেত্রে সংকট প্রকটরূপে দেখা দেয়। জার্মানির ভাইসার প্রজাতন্ত্র সাম্যবাদী আদর্শকে ঠেকালেও জনগণের স্বপ্নকে স্বার্থক করে তুলতে বা তাদের নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারছিল না।

৪. সাম্রাজ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: জার্মানিতে হিটলারের নাৎসিবাদ উত্থানের অন্যতম কারণ হলো সাম্রজ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ছলেবলে কৌশলে ইউরোপের জার্মান ভাষাভাষি মানুদের নিয়ে বিশাল জার্মান সাম্রাজ্য গঠন করে জার্মানিকে পৃথিবীর সর্বপেক্ষা শক্তিধর জাতিরূপে গড়ে তোলাই ছিল হিটলারের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই সময় হিটলারের নাৎসিবাদে আকৃষ্ট হয়ে জার্মানির অসংখ্যায় যুবক, যুবতী, কৃষক, ব্যবসায়ী ও সর্বশ্রেণির জার্মান তাঁর নাৎসি দলে যোগদান করতে থাকে। অচিরেই হিটলার ও তাঁর নাৎসি দল জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

৫. নাৎসি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: ১৯৩৩ সালে হিটলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিছুদিনের মধ্যেই হিটলার সকল ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে দেশে নাৎসি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে জার্মানিতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর নাৎসি দল জার্মানির শাসক দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গ্রেফতার, অপহরণ, নির্বাসন, গোপন হত্যা প্রভৃতির মাধ্যমে জার্মানির কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের নির্মমভাবে দমন করে হিটলার ও তাঁর নাৎসি দলের সাহায্যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দখল করে নেন। অতঃপর নাৎসি পার্টি জার্মানিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং হিটলার হন তার একচ্ছত্র ডিটেক্টর।

৬. নাৎসি পার্টির ইশতেহার হিটলার ১৯২০ সালে জার্মানির শ্রমিকসংঘ এক জনসভায় ২৫ দফা সংবলিত নাৎসি পার্টির এক ইশতেহার প্রকাশ করে। এই ইশতেহারটি তৎকালীন জার্মানির অস্থিতিশীল রাজনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার করে। জার্মানির যুব সম্প্রদায় হিটলারকে তাদের স্বপ্নপুরুষ মনে করে নাৎসি দলের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। নাৎসি পার্টিতে হিটলারের প্রভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়, যা তাকে পরবর্তীকালে পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত করে তোলে।

৭. একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: হিটলার কর্তৃক নাৎসিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ ছিল জার্মানিকে শুধু জার্মানদের নিয়ে একক শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। উনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানি আর অস্ট্রিয়ায় এক ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যার উদ্দেশ্য ছিল একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং যার ভিত্তি হবে অর্থরক্ত, ভাষা হবে জার্মান এবং যা হবে সকল ধর্মীয় বিশ্বাসযুক্ত। এই আন্দোলনই ছিল নাৎসিবাদ।

৮. ভার্সাই চুক্তির বিরোধিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণে ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানি তার যাবতীয় উপনিবেশ হাতছাড়া করে। শুধু তাই নয়, উপনিবেশ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করা হয়েছিল, তাও বিফলে গেল। আর জার্মানি হারিয়েছিল কৃষিযোগ্য জমির শতকরা সাড়ে পনেরো ভাগ, উৎপাদন শিল্পের শতকরা দশ ভাগ, মজুত কয়লার দুই-পঞ্চমাংশ, খনিজ লোহার দুই-তৃতীয়াংশ। জার্মানিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভার্সাই চুক্তির এ নীতিকে হিটলার ও তার দল নাৎসি পার্টি বিরোধিতা করে জার্মানিতে নাৎসি পার্টির উদ্ভব ঘটায়।

৯. উগ্রজাতীয়তাবাদ: হিটলারের ধারণা ছিল জার্মান জাতি পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র উৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্ঠ জাতি অন্যরা নিকৃষ্ট। অতএব নিকৃষ্টের উপর শ্রেষ্ঠত্বের কর্তৃত্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক। জার্মান জাতি গোটা ইউরোপের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এই স্বপ্নে হিটলার পরিপূরক ছিলেন। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে গিয়ে তিনি জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান ঘটান।

১০. ফ্যাসিবাদের বিকল্প ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে নিঃস্ব করেছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর জার্মানির একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেকোনো প্রকারের যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া। জাপান ও ইতালি মনে করেছিল যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সব রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত তাই অর্থনৈতিক পূনর্গঠনে তারা অপরিহার্য মনে করেছিল। তাই হিটলার ইতালির ফ্যাসিবাদে আকৃষ্ট হয়ে জার্মানিতে নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, নাৎসিবাদ বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা একনায়ক উগ্রজাতীয়তাবাদী জার্মান নেতা হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে যে নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছে তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। নাৎসি জার্মানির জন্য একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের সাধনা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে অস্থিতিশীল নাৎসি জার্মানির বিশ্ব আসনে অপ্রতিদ্বন্দী শক্তি হিসেবে জন্ম হয়েছিল।

পরবর্তী

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ