- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- অনার্স
- আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
ভূমিকা: বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার কারণে রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তাই রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন অন্যান্য রাষ্ট্রচিন্তা থেকে কোনো অংশে কম নয়। ইসলামের নির্দেশিত পন্থায় ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন অপরিহার্য। এ রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের মধ্য দিয়ে নৈতিকতা, মানবতা, আদর্শবাদ ইত্যাদি বিষয়ে আমরা সম্যক ধারণা পেতে পারি। নিম্নে রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো-
১. গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের প্রভাব: গ্রিক দর্শনের আলোকে রাষ্ট্রদর্শন গড়ে উঠেছিল। কেননা মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ নিজেদের মতামতকে বিশ্লেষণ করেছিল গ্রিক দর্শনের ভিত্তিতে। আল ফারাবির রাষ্ট্রদর্শনে প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনই মূলত ফুটে উঠেছে। এভাবে ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রমুখ মুসলিম দার্শনিক ইসলামি ধর্মমতের সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
২. মানব কল্যাণে রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রচিন্তায় সর্বজনীন : মানবতাবাদের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তাই এ রাষ্ট্রদর্শনকে আখ্যায়িত করা হয় সমাজকল্যাণধর্মী রাষ্ট্রচিন্তা হিসেবে। চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মুসলিম দার্শনিকগণ সার্বজনীন ইসলামি মানবতাবাদকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। এছাড়া কৌটিল্য, মানবেন্দ্রনাথ রায় সকলেই ছিলেন মানবতাবাদের পক্ষে। সুতরাং রাষ্ট্রদর্শন অধ্যয়নে মানবতাবোধ জাগ্রত হতে পারে।
৩. সভ্যতায় উৎকর্ষ সাধন: জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রের কাঠামো হতে শুরু করে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, সামাজিক দায়িত্ববোধ সবকিছুরই সমন্বয় ঘটেছে রাষ্ট্রদর্শনে। তাই এটা অধ্যয়নে ভবিষ্যৎ সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন সম্ভব।
৪. শাস্তি ও সার্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুদ্ধ, শান্তি ও নিরাপত্তা যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরিহার্য বিষয়। রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়। সমাজে শাস্তি প্রতিষ্ঠা, অন্যায় যুদ্ধ হতে বিরত থাকা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর এসব বিষয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই একটি সমৃদ্ধশালী
রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করতে পারে।
৫. ধর্মের প্রতি গুরুত্বারোপ: ধর্মের ওপর রাষ্ট্রচিন্তায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো ও ভারতের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ মনু থেকে কৌটিল্য, চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস, মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবি প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ঐশ্বরিক ধারণার মধ্য দিয়ে কৌটিল্য রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং চরম রাজার ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন 'কল্যাণকামী রাজা' হিসেবে। অন্যদিকে অধিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের সম্প্রসারিত রূপই আল ফারাবীয় রাষ্ট্রদর্শন। এভাবে মহাত্মা গান্ধী ও কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে ধর্ম গুরুত্ব পেয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের ফলে ধর্মের মূল স্রোতে প্রবেশ করে ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়।
৬. রাজতন্ত্রের প্রাধান্য: এ সময়ে রাষ্ট্রদর্শন অধ্যয়নে শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণও শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কনফুসিয়াস ও কৌটিল্য হতে শুরু করে মুসলিম দার্শনিকগণও খেলাফত ও প্রথা ব্যবস্থার কথা বলেছেন তা ছিল রাজতন্ত্রের সম্প্রসারিত রূপ। তাই রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে রাজতন্ত্র সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন সম্ভব।
৭. কট্টর রক্ষণশীল মনোভাব কট্টর রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রদর্শন কনফুসিয়াস, কৌটিল্য, মাহাত্মা গান্ধী এবং মুসলিম দার্শনিকদের কেউই তাদের রাষ্ট্রদর্শনে মৌলিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন করেননি, বরং নিজস্বতা ধরে রেখেছিলেন। কনফুসিয়াস নীতিগত সমাজ পরিবর্তনের কথা বললেও কট্টর কৌটিল্য বৈষম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা সংরক্ষণে তৎপর ছিলেন। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে সমাজের কট্টর রক্ষণশীল মনোভাব সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
৮. নৈতিকতার প্রাধান্য রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নৈতিকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। চীনের দার্শনিক লাওসের রচিত 'তাওতে চিঙ' গ্রন্থের মূলকথাই হচ্ছে নৈতিকতা। অন্যদিকে, পাঁচটি নৈতিক কর্তব্যকে ভিত্তি করেই কনফুসিয়াস তার রাষ্ট্রদর্শনের ব্যাখ্যা করেছেন, যা ইতিহাসে 'ফাইভ চিঙস' নামে পরিচিত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও নৈতিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় নৈতিক বিধানাবলিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৯. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। তৎকালীন রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ও কেন্দ্র হিসেবে ন্যায়বিচারকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীগণ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যেকোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন অপরিহার্য।
১০. আদর্শবাদের প্রাধান্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের রাষ্ট্রদর্শনে তথ্যের সত্যতার চেয়ে আদর্শের সাথে সামঞ্জস্য আছে কিনা তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারতবর্ষের কৌটিল্য হতে শুরু করে মধ্যযুগের মুসলিম চিন্তাবিদগণ সকলেই নৈতিক আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে আদর্শ রাজনীতিবিদ ও আদর্শ নাগরিক হওয়া সম্ভব।
১১. অভিজ্ঞতার গুরুত্ব রাষ্ট্রচিন্তা ছিল উন্নত পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। পূর্ব অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েই কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রকে সরকার সুসংহত করার ওপর জোর দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে নিজামুল মূলক বা. তুসীর রাষ্ট্রচিন্তার ধর্মীয় নৈতিকতাবাদের সাথে অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণ করেছেন। তাই রাষ্ট্রচিন্তা
অধ্যয়নে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ধারণা পাওয়া যায়।
১২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন: রাষ্ট্রচিন্তায় ইসলামি চিন্তা- চেতনার প্রভাব বেশি থাকায় এর পরিধি ব্যাপকতা লাভকরেছিল। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রচিন্তা পরিব্যাপ্ত ছিল। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহর ভূমিকা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কে রাষ্ট্রদর্শনে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা আন্তর্জাতিকতার বৈশিষ্ট্য বহন করে। তাই রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নে একজন মানুষ জ্ঞানের পরিপূর্ণতা অর্জন করে এবং সমাজের প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ফলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনেই নয়; পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রচিন্তা মুসলিম দার্শনিকের দ্বারা সমৃদ্ধ হওয়ায় তা পারলৌকিক মুক্তিরও পথ দেখায়। তাই পারলৌকিক মুক্তি ও ইহলৌকিক শান্তির জন্য রাষ্ট্রদর্শন অধ্যয়ন অতাবশ্যকীয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ