- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- অনার্স
- আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশে জাতীয়তাবাদ ও লোকায়তবাদের প্রভাব বর্ণনা কর।
ভূমিকা: পরিবর্তনশীল পৃথিবী ক্রমান্বয়ে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছে। পরিবর্তনের এ ঢেউ ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রেই আন্দোলিত করে চলেছে। রাষ্ট্র একটি গতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা মানুষের জীবনের সর্বাধিক বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল প্রকৃতিতে, রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের চিন্তাধারায়ও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। তাই যুগে যুগে রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রচিন্তার যে ভিন্নতা বিদ্যমান এটাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাষ্ট্রচিন্তা নামে পরিচিত। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এ তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রাচীনকালে রাষ্ট্রচিন্তা ছিল নগরভিত্তিক মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা ছিল গির্জাকেন্দ্রিক আর আধুনিক যুগের রাষ্ট্রচিন্তা উদারতাবাদ ও যুক্তিবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয়তাবাদ: ষোড়শ শতাব্দী থেকে অদ্যাবধি মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণাকে যেসব রাষ্ট্রীয় আদর্শ বিশেষভাবে প্রভাবিত করে আসছে জাতিবাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। যুগ যুগ ধরে এক সাথে বসবাস করার ফলে একই ভাষা, ঐতিহ্য, আচার-ব্যবহার, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সুখ ও দুঃখ ইত্যাদির প্রভাবে একত্রিত হয়ে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী জাতিতে পরিণত হয়। আর ঐ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত সম্মিলিত চেতনাই জাতীয়তাবাদ নামে অভিহিত। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধির কারণ আলোচনা করা হলো-
১. ফরাসি বিপ্লব: ফরাসি বিপ্লব হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ফরাসি বিপ্লবের অভিঘাত পুরানো সমাজকাঠামো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গতানুগতিক রাষ্ট্রের সীমা সম্পর্কিত ধারণা চূর্ণ করে দেয়। প্রধান তিনটি ধারায় বিপ্লবোত্তর ইউরোপে জাতীয়তাবাদ প্রবাহিত হয়। যথা- (ক) রক্ষণশীল জাতিবাদ, (খ) উদারনৈতিক জাতিবাদ ও (গ) গণতান্ত্রিক জাতিবাদ।
২. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি যোগাযোগ ব্যবস্থায় দ্রুত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হওয়ায় মানুষের মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন, নতুন মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা ও মনোভাব বিনিময়ে পূর্বের তুলনায় সহজতর হয় যা রাষ্ট্রচিন্তায় জাতীয়তাবাদের প্রভাব বিস্তারে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে।
৩. জাতীয়তাবাদী স্বাধীন চেতনা বৃদ্ধি: ফরাসি বিপ্লব যেমন জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি শিল্প বিপ্লবোত্তরকালেই জাতীয়তাবাদী চেতনা ইউরোপে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেননা এ বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদী সমাজ বিকাশ লাভ করে। বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এর ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৪. জাতীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি: জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা চৌদ্দ শতক থেকে আঠার শতক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে মধ্যযুগীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজব্যবস্থা পতনের সাথে সাথে চিন্তার ক্ষেত্রে যে বিশ্বজনীন ধারণাটি প্রবাহমান ছিল তা রোমক আইনের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আইন। পরবর্তী পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্বভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের চিন্তা ও চেতনার বিকাশে এসবের অবসান ঘটে। অতএব এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য ও পশ্চিমা কৃষ্টির বিশ্বজনীন ধারায় ভগ্নস্তূপে জাতীয় রাষ্ট্রের বুনিয়াদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. আদর্শগত বুনিয়াদ সৃষ্টি সনাতন ধ্যান-ধারণা ও ধর্মীয় চেতনার পতনের ফলে অগণিত মানুষের ধর্মীয় আনুগত্যের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার ফলে এর প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। প্রায় সকল আধুনিক রাষ্ট্রের আদর্শগত বুনিয়াদ জাতীয়তাবাদের প্রভাবকে আরও বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন প্রকার কৃষ্টি, আচার-অনুষ্ঠান, যেমন- জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার ইত্যাদি জাতীয়তাবাদকে দ্রুতগতিতে প্রভাবিত করেছে।
৬. জাতীয় চেতনাবোধ সৃষ্টি জাতীয় চেতনাবোধ জাতিবাদ বিকাশের অন্যতম কারণ। রাজশক্তি নয় জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার ধারক ও বাহক এ ধারণা রুশোর লেখনীতেই প্রথম প্রকাশ পায়। আঠার শতকে রুশোর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসি বিপ্লবীরা রাজশক্তির কবল থেকে জনশক্তির হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে সোচ্চার হয়ে বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়।
লোকায়তবাদ: লোক বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যে তত্ত্বের উন্মেষ ঘটেছে তাকে লোকায়তবাদ বলে। লোকায়তবাদ বা ধর্ম নিরপেক্ষতার মূল কথা হলো ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যারে না, ধর্ম ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে তার ফলে স্থবির সনাতন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে থাকে এবং তা করতে গিয়ে একদিকে যেমন চুক্তির আশ্রয় নেয় তেমনি অপরদিকে উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এ পরিবেশে লোকায়তকারী চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করে। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় লোকায়তবাদের প্রভাব বৃদ্ধির কারণ আলোচনা করা হলো-
১. ফরাসি বিপ্লব: ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবকে লোকায়তবাদের অন্যতম উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। ফ্রান্সে সনাতন ব্যবস্থা ফরাসি বিপ্লবের ফলে ভেঙ্গে পড়ে। বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্ব চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে এক প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। ব্যক্তিকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। আর এ চেতনার উৎস ধরেই লোকায়তবাদী ধারণা প্রবল হতে থাকে।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতা: ব্যক্তির মত বা স্বাধীনতা পৃথক সত্তা এ ধারণাই ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। জে. এস. মিল তাঁর বিখ্যাত 'On Liberty' গ্রন্থে বলেছেন, "ব্যক্তিচরিত্রের সর্বাধিক বিকাশের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা আবশ্যক। অর্থাৎ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।"
৩. বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার লোকায়ত চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। বৈজ্ঞানিকগণ পরম উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে নব নব আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেন। তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে দৃঢ় পদক্ষেপ এগিয়ে আসেন সৃষ্টির অপার রহস্য উদঘাটনের কাজে এবং মানবকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশকে তারা সভ্যতা বিকাশের কাজে নিয়োজিত করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে।
৪. জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বৈজ্ঞানিকগণের গবেষণামূলক কর্ম ও আবিষ্কারের ফলে তারা কুসংস্কারমুক্ত হন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রাধান্যকে তারা মেনে নিতে নারাজ। তারা সবকিছু যুক্তি ও বিবেক দিয়ে যাচাই করে নিতে আগ্রহী হয়।
৫. উপযোগবাদ: উপযোগবাদের সর্বপ্রথম প্রবক্তারূপে বেন্থাম, জেমস মিল ও তাঁর পুত্র জন স্টুয়ার্ট মিল আত্মপ্রকাশ করেন। বেনামের মতে, "সবকিছু মানুষের উপযোগিতা অনুসারে হওয়া উচিত।" তাঁর মতে, "শাসনব্যবস্থা এবং আইনব্যবস্থা যাই হোক না কেন, তার মূলনীতি হবে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করা।"
৬. সামাজিক ধ্যান-ধারণা: শিল্পবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভব ঘটে পুঁজিবাদের পুঁজির অসম বিন্যাসের ফলে সমাজে কুফল দেখা দেয় এবং তা দূর করার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদের। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা লোকায়তবাদকে প্রভাবিত করেছে বিশেষভাবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সারা বিশ্বে জাতীয়তাবাদ ও লোকায়তবাদের প্রভাব মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করেছে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই দশকের মধ্যে প্রায় ১২৫ কোটি লোক মুক্তি লাভ করেছে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের অবসান ঘটেছে যা ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনারই ফলশ্রুতি।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ