- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- অনার্স
- আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আর্থসামাজিক পটভূমি
রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য কি কি? বর্ণনা কর।
ভূমিকা: গ্রিক যুক্তিবাদের শান্ত পরিবেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম সূত্রপাত। প্রাচীন গ্রিক ছিল সভ্যতার লীলাভূমি। তখনকার গ্রিস থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়েছে। আর এই প্রাচীন গ্রিসেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদের জন্ম হয়েছিল। যাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতিতে ন্যায়বোধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের যুক্তি ইত্যাদি। একটি নির্দিষ্ট প্রবণতার প্রাধান্যের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটলেও রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ধারবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসমূহের মধ্যে বিশাল এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক এবং ধর্মীয় অবস্থার কারণে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছে।
রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য: নিম্নে রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-
১. নৈতিকতার প্রভাব রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে নৈতিকতার বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে। এ নৈতিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে অনেকে বলেন, রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে অধিক হলো নৈতিকতার প্রকৃতির। প্রাচীন গ্রিসের সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো ও প্রাচীন ভারতের মনু ও কৌটিল্যের রাজনৈতিক দর্শনেও নৈতিকতার ওপর প্রভাব পড়েছিল। প্রাচীন চীনের রাষ্ট্রদর্শনেও নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম।
২. আদর্শ ও নীতিবোধের প্রাধান্য রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আদর্শ ও নীতিবোধের প্রাধান্যকে চিহ্নিত করা হয়। কেননা রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে আদর্শবাদের বিরাট প্রভাব ছিল। মূলত আদর্শবাদের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রচিন্তার উন্নতি সাধিত হয়েছে। তার মধ্যে গ্রিক রাষ্ট্র দর্শনে বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালে গ্রিক চিন্তাবিদরা তাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা দিয়ে 'অন্যান্যদেরকে প্রভাবিত করেছে। গ্রিক পণ্ডিতদের মধ্যে যে সকল চিন্তাবিদ তাদের চিন্তা-চেতনার দ্বারা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল অন্যতম। কৌটিল্যের আদর্শবাদের জন্য যেমন-ভারতে সমাজব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরাট উন্নতি সাধিত হয়, তেমনি মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের রাষ্ট্রদর্শনকে অনেকে ইসলামি ভাবাদর্শে সম্প্রসারিত করে।
৩. মানবতাবাদ: রাষ্ট্রচিন্তায় মানবতাবাদের বিরাট ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। চীনের রাষ্ট্রদর্শনে মানবতাবাদের বিরাট প্রভাব ছিল। গ্রিসের সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো ও চীনের কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে মানবতাবাদের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ভারতের কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনেও মানবতাবাদের সুর অনুরণিত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শনে ইসলাম সার্বজনীন মানবতাবাদের প্রতিফলন লক্ষণীয়। আধুনিককালে ভারতের এম. এন. রায় এক বিজ্ঞানভিত্তিক বলিষ্ঠ মানবতাবাদী দর্শন গড়ে তোলেন, যা 'Radical humanism' নামে সবিশেষ পরিচিত।
৪. রাজতান্ত্রিক ধারণার প্রাধান্য রাষ্ট্রচিন্তায় রাজতান্ত্রিক আদর্শের ধারণা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। প্লেটো দার্শনিক রাজার শাসনের কথা বলেছিলেন সুস্পষ্ট। তাছাড়া চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস রাজতন্ত্রকেই সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি রাজার ভূমিকাকে রাজতান্ত্রিক পৈতৃক মাধ্যমে (Kingship paternalism) ধারণার প্রকাশ করেন। কনফুসিয়াস মনে করেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে পিতৃতুল্য রাজনৈতিক সরকারের ধারণাই গ্রহণযোগ্য। কৌটিল্য কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশ সাধন করেন। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রদার্শনিকগণ আল্লাহর প্রতিনিধিভিত্তিক খেলাফত ব্যবস্থার কথা বলেন।
৫. কট্টর ও রক্ষণশীলতা রক্ষণশীলতা রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কৌটিল্য, কনফুসিয়াস ও গান্ধীর রাষ্ট্রচিন্তায় রক্ষণশীলতার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কৌটিল্য নিজে বর্ণবৈষম্য সমাজব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষে মত পোষণ করেন। তবে কনফুসিয়াস সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বললেও আমূল পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন না।
৬. ন্যায়বিচারের প্রাধান্য কৌটিল্য তার রাষ্ট্রদর্শনে ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। এক পর্যায়ে কৌটিল্য বলেন, আইন অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তা কার্যকর না হয়। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় অধিকরণে আইন ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। কনফুসিয়াসও ন্যায়বিচার ধারণাকে রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু বলে চিহ্নিত করেছেন। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকগণ ইসলামের ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বিচার ধারণাকে যথাযথ প্রয়োগ করেন।
৭. অভিজ্ঞতাবাদী প্রভাব রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট থাকলেও অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতির বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গ্রিসের সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো ও প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রচিন্তার যে রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ভিত্তি হলো অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণ। কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনে ধর্মীয় প্রভাবের প্রতি বেশি জোর দেয়া হলেও সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর সম্পর্ক, কার্যাবলি, দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কনফুসিয়াসের দর্শনেও অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব লক্ষণীয়।
৮. ধর্মীয় প্রাধান্য: প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে প্রাচীনকালে গ্রিক মিসর, ভারত ও চীনে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো ও চীনের দার্শনিকদের মধ্যে কনফুসিয়াস ও মেনসিয়াসের মতবাদ ধর্মীয় ভাবধারার আলোকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। ভারতেও কৌটিল্যের বৈদিক সমাজব্যবস্থার প্রতি ছিল দৃঢ় বিশ্বাস এবং তিনি এ সমাজব্যবস্থার সারবস্তুকে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন।
৯. ইসলামি দর্শনের সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়: রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকগণের রাষ্ট্রচিন্তা। সে সময়ের মুসলিম দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয় ঘটেছিল। আল ফারাবির রাষ্ট্রদর্শনে স্টোয়িকবাদের প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয়, তেমনি আল গাজ্জালি ছাড়াও মধ্যযুগের ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ দার্শনিক ইসলামি দর্শনতত্ত্বের সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয় সাধনে তৎপর ছিলেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তার তুলনায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার পরিধি সীমিত। তবে রাষ্ট্রচিন্তার পরিধি সীমিত হলেও রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনাকে ধারণ করেই এর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ