• হোম
  • একাডেমি
  • মাদরাসা
  • নবম-দশম শ্রেণি
  • প্রাক-ইসলামি পটভূমি ও রাসুল (স.) এর মক্কা জীবন
প্রাক-ইসলামি পটভূমি ও রাসুল (স.) এর মক্কা জীবন

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রাক-ইসলামি পটভূমি ও রাসুল (স.) এর মক্কা জীবন

প্রাচীন আরবের ভূ-প্রকৃতি

পবিত্র আরব ভূ-খণ্ড পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উপদ্বীপ। এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ ভূ-খণ্ডের তিন দিকে সমুদ্র ও একদিক স্থল দ্বারা বেষ্টিত। তাই এ ভূখণ্ডকে 'জাজিরাতুল আরব' ( جَزِيرَةَ الْعَرَبِ ) বা আৱৰ উপদ্বীপ বলা হয়ে থাকে। এর পূর্বদিকে পারস্য উপসাগর, পশ্চিমে লোহিত সাগর, উত্তরে সিরিয়া মরুভূমি এবং দক্ষিণ দিকে ভারত মহাসাগর অবস্থিত।
তবে ভূ-প্রকৃতির দিক থেকে আরবভূমি সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার মরু অঞ্চলের অংশ ছিল। ধারণা করা হয়, আরবভূমি সাহারা ভূমির অন্তর্ভুক্ত ছিল। লোহিত সাগরের তীরব্যাপী একটানা পর্বতমালাকে আরব অঞ্চলের মেরুদন্ড বলা হয়ে থাকে। লক্ষণীয় যে, সমগ্র আরব ভূখণ্ড পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত চালু। পূর্বদিকে ওমান পর্বতমালা, দক্ষিণাঞ্চল নিচু এবং কিয়দাংশ চালু, উত্তরের নজদ একটি উচ্চ মালভূমি। পাহাড় ও মালভূমি ছাড়া বাকি অংশ মরু অঞ্চল এবং অনুর্বর ভূমি।

আরবের উত্তরাংশে রয়েছে নুফুদ (২) বা সাদা ও লালচে বালিযুক্ত অঞ্চল। কোথাও বা উঁচু ঢিবি আবার কোথাও বা বালিয়াড়িতে পরিণত হয়ে উত্তর আরবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল আবৃত করে রেখেছে। এর প্রাচীন নাম হল আল-বাদিয়া (أَنادِيةُ)। উত্তরে নুফুদ থেকে দক্ষিণে আল-রাব-আল-খালি পর্যন্ত বিস্তৃত লাল বালিপূর্ণ আদ-দাহনা (ক) বা সালভূমি দক্ষিণ-পূর্বদিকে এক বিরাট বক্ররেখা বরাবর ৬০০ মাইলের বেশি বিস্তীর্ণ। পুরোনো মানচিত্রে আদ-দাহনা সাধারণত 'আল্-রাব-আল-খালি' (ফাঁকা অঞ্চল) নামে অভিহিত।

আয়তন: আরব ভূ-খণ্ডের আয়তন ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল (২৬,৫৮,৭৮১ বর্গ কিলোমিটার)। প্রাচীনকালে ভূমধ্যসাগরের এ স্রোতধারা উপদ্বীপকে প্লাবিত করে কিছুটা তৃণময় ও মানুষের বাসোপযোগী করে তোলে।

ভৌগোলিক পরিচিতি: ভৌগোলিক পরিচিতির দৃষ্টিকোণ থেকে আরবকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রিক ভূগোলবিদদের মতে এ ভাগগুলো হলো- মরু অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল ও উর্বর অঞ্চল। মরু অঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চল ব্যতীত আরবের উর্বর তৃণ অঞ্চল হিজাজ, নজদ, ইয়ামেন, হাজরামাউত এবং ওমান এ কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিজাজ আরবদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত এবং মক্কা, মদিনা ও তায়েফ এর তিনটি প্রধান শহর। দক্ষিণ আরবে অবস্থিত হাজরামাউত, ওমান ও ইয়ামেন অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যের জন্য খুবই বিখ্যাত। অপরদিকে মরু অঞ্চল ছিল প্রতাপে বিদগ্ধ ও গুল্মশূন্য, বসবাসের অনুপযোগী উত্তপ্ত এলাকা। কখনও কখনও মরু অঞ্চলে বিষাক্ত লু-হাওয়া প্রবাহিত হয়।

আবহাওয়া: আরব উপদ্বীপটি অত্যন্ত শুদ্ধ ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। পূর্ব ও পশ্চিমে সমুদ্রবেষ্টিত হলেও সেই জলরাশি এখানকার ভূমি সিক্ত করতে পারে না। কারণ, আরবভূমির অধিকাংশই আফ্রিকা ও এশিয়ার বৃষ্টিহীন বিপুল প্রান্তর। তাই তার আবহাওয়ায় অনাবৃষ্টির রুক্ষতার প্রাধান্যই বেশি। দক্ষিণ সমূদ্র থেকে স্বাভাবিক কারণেই জলবাহী মেঘ ওঠে, কিন্তু মরুর বালুঝড় (সাইমুম) তা বাতাসেই শুষে নেয়। ফলে সেই মেঘ যখন আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছায় তখন তাতে জলীয় বাষ্প আর অবশিষ্ট থাকে না। ওমান, হাজরামাউত, হিজাজ প্রভৃতি উপকূলবর্তী অঞ্চল ও পানি বিধৌত উপত্যকায় সামান্য বৃষ্টিপাত হয়। চাষের উপযোগী বৃষ্টিপাত হয় ইয়ামেন ও আসীর প্রদেশে। ইয়ামেনের আধুনিক রাজধানী সানা সমুদ্র হতে ৭০০ ফুট (২১৩.৩৬ মিটার) উচ্চে অবস্থিত এবং এটি আরবের অন্যতম সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর স্থান।

আরব উপদ্বীপের বৈশিষ্ট্য: আরব উপদ্বীপ একটি বিশাল ও বিস্তৃত মালভূমি। এ উপদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত অন্যান্য অংশ বা অঞ্চল হতে অনেক উঁচু। এদেশের ভূখণ্ড পশ্চিম হতে পূর্বদিকে ক্রমান্বয়ে চালু ভূমি দ্বারা গঠিত। মধ্যআরবে কিছু পর্বতশৃঙ্খ পরিদৃষ্ট হয়। এগুলো সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৪০০০ থেকে ৬০০০ ফুট উঁচু (যথাক্রমে ১২১৮ ও ১৮১৯ মিটার)। এ আরব ভূখণ্ডের জলবায়ু সর্বত্র উষ্ণ। এদেশে নাব্য নয় এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু সংখ্যক নদ-নদী রয়েছে। ভূমি অনুর্বর। কেবলমাত্র মরুদ্যান এবং উপকূলভাগ অপেক্ষাকৃত উর্বর।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মিলনকেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান থেকেও যেন সমগ্র বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন। আরব ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ মরুময়। উত্তর ভাগে 'নুফুদ' মরুভূমি এবং নুফুন্দ হতে আরম্ভ করে দক্ষিণ ভাগ পর্যন্ত ৬০০ মাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে আরবের বৃহত্তম মরুভূমি 'আদ-দাহনা' ('আল্-রাব-আল্-খালি')। এতদ্ব্যতীত এদেশের পশ্চিম দিকে রয়েছে আল-হাররাহ নামক আর একটি ক্ষুদ্র মরুভূমি।

কতিপয় পর্বতমালা, কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদ-নদী, স্বল্পসংখ্যক মরূদ্যান এবং এক বিশাল ও বিস্তৃত মরুভূমি বুকে নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে বিদ্যমান রয়েছে প্রাচীনকালের আরব উপদ্বীপ বা আরবদেশটি। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি গুরুত্বপূর্ণও বটে।

আরবের ফসলাদি ও প্রাকৃতিক সম্পদ: খেজুর আরবদের প্রধান খাদ্য। খেজুর ছাড়া তাদের জীবন ধারণ করা ছিল কষ্টকর। খেজুর গাছ আরব দেশে 'বৃক্ষরাণী' হিসেবে খ্যাত। স্থানীয় লোকজনের বহুবিধ প্রয়োজন ছাড়াও খেজুরের বীজ চূর্ণ করে উটের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খেজুর গাছের মিষ্টি ব্রুস আরব বেদুইনদের অন্যতম পানীয়। প্রত্যেক বেদুইনের স্বপ্ন হল 'দুটি কৃষ্ণ দ্রব্য' (আল-আসওয়াদান) অর্থাৎ পানি ও খেজুর। হিজাজে প্রচুর পরিমাণে খেজুর উৎপন্ন হয়। ইয়ামেনের কয়েকটি মরূদ্যানে উৎপন্ন হয় গম। ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে চাষ হয় বার্লি, কয়েকটি অঞ্চলে ভুট্টা এবং ওমান ও আল-হাসায় ধান উৎপন্ন হয়। আরবীয় মরূদ্যানে উৎপন্ন অন্যান্য ফলের মধ্যে বেদানা, বাদাম, কমলালেবু, কাগজি লেবু, আখ, তরমুজ ও কলা উল্লেখযোগ্য।

আরবের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে আরবের ইয়ামেন অঞ্চল ও কেন্দ্রীয় আরবের কয়েকটি সখানে খাঁটি সোনা পাওয়া যেত। আরবের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে পেট্রোল, স্বর্ণ, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি।

আরবের প্রাণী: আরবের জীবকুলের মধ্যে চিতাবাঘ, হায়েনা, নেকড়ে, শিয়াল ও গিরগিটি উল্লেখযোগ্য। শিকারী পাখির মধ্যে ঈগল, বাজপাখি ও পেঁচা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অতি পরিচিত পাখির মধ্যে ঝুঁটিওয়ালা পাখি (হুদহুদ), বুলবুল, পায়রা ও আরবি সাহিত্যে আল-কাতা নামে পরিচিত এক ধরনের তিতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। গৃহপালিত পশুর মধ্যে উট, ঘোড়া, গাধা, সাধারণ কুকুর, শিকারী কুকুর, বিড়াল, ভেড়া, ছাগল প্রধান। দৈহিক সৌন্দর্য, কষ্ট সহিষ্ণুতা, বুদ্ধি এবং মনিবের প্রতি মর্মস্পর্শী আনুগত্যের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ও উত্তমভাবে প্রতিপালিত আরবিয় ঘোড়া এক অনন্য দৃষ্টান্ত। উটের সাহায্য ছাড়া মরু অঞ্চল কখনই মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত না। উট ছিল যাযাবরদের ধাত্রীসম। উত্তপ্ত মরুভূমিতে উট ছিল আরবদের একমাত্র যাতায়াতের বাহন। তাই উটকে 'মরুভূমির জাহাজ' বলা হয়। পবিত্র কুরআন শরীফে আরবদের জন্য এক বিশেষ অবদান হিসেবে উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরবদের মধ্যে উটের ব্যবহার ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। যার যতো বেশি উট ছিল সে ছিল ততো বেশি ধনী। উট বেদুইনদের নিত্য সহচর ও পথের বন্ধু। উটের মাংস তাদের খাদ্য এবং দুগ্ধ ছিল পুষ্টিকর পানীয়। উটের চামড়া দিয়ে তারা তাবু এবং পশম দিয়ে পোশাক তৈরী করত।

আরব জাতি: আরব উপদ্বীপের আদিম অধিবাসীদের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য নিরূপণ করা এখনও সম্ভব হয় নি। তবে স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্দীপ্ত আরব জাতি প্রধানত দু'ভাগে বিভক্ত: যথা- বারদা (أَلْبَيِّدَ) বাকিয়া (الاقية)। কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রখ্যাত প্রাচীন বংশ 'আদ', 'সামুদ', 'তামস' ও 'জাদিস' প্রভৃতি প্রাচীন আরব গোত্রগুলো প্রথম শ্রেণিভুক্ত ছিল। পরবর্তী জাতিগুলোর মধ্যে অভ্যুত্থানে প্রাচীন বায়দা গোত্রগুলো বিলুপ্ত হয়।

অধুনালুপ্ত বায়দা গোত্রের উত্তরাধিকারী 'বাকিয়া' জাতি বর্তমান আরব ভূখণ্ডের প্রধান অধিবাসী। এ 'বাকিয়া' শ্রেণিভুক্ত আরবদের দু'ভাগে বিভক্ত করা যায়। 'প্রকৃত আরব বা আরিবা' (عربة) ও 'আরবিকৃত আরব'বা মুস্তারিবা। সর্বাপেক্ষা আদিম ও নিষ্কলুষ রক্তের অধিকারী আরিবা গোত্র কাহভানের বংশোদ্ভূত। দক্ষিণ আরবের ইয়ামেন অঞ্চলের অধিবাসী ছিল বলে তাঁরা ইয়ামেনীয় বা হিমারিয়া বলে পরিচিত ছিল। কাহতানের বংশের অভ্যুত্থান হতেই আরব জাতির প্রকৃত ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। উল্লেখ্য যে, রক্তের পবিত্রতার জন্য আরিবা অথবা ইয়ামনীয়রা মুস্তারিবা গোত্রের তুলনায় অধিক ক্ষমতাশালী ছিল এবং মদিনায় হিজরত করার পর প্রকৃতপক্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের নিকট হতে সহযোগিতা লাভ করেন। ইসমাইল (আ.)-এর একজন বংশধর আদনান মুস্তারিবা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হিজাজ, নজদ, পেত্রা, পালমিরা অঞ্চলে বসবাসকারী মুস্তারিবা গোত্রের নিযারী হতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কুরাইশ বংশের উদ্ভব হয়। মুস্তারিবাগণ উত্তর আরবের হিজাজের অধিবাসী হিসেবে 'হিজাজি'বা 'মুদারি' নামেই সমধিক পরিচিত লাভ করেন।

উত্তর আরবগোত্র সাধারণভাবে নির্ধারি অথবা মুদারি নামে অভিহিত এবং সাধারণত তারা যাযাবর জীবন যাপন করত। অপরদিকে দক্ষিণ আরব অথবা ইয়ামেনিরা ছিল নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। কারণ, তারা সাবিয়ি ও হিমায়ারি রাজ্যের অধিবাসী ছিল। উত্তর আরবের লোকেরা কুরআন শরীফের ভাষা অর্থাৎ আরবিতে কথা বলত। দক্ষিণ আরবের লোকেরা প্রাচীন সেমেটিক ভাষা, সাবেয়ি ও হিমায়ারি ব্যবহার করত। কৃষ্টির দিক হতে বিচার করলে দক্ষিণ আরবের সভ্যতার উন্মেষ হয় খ্রিস্টের জন্মের ১২শত বছর পূর্বে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত উত্তর আরব ইতিহাসে কোনো উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করতে পারেনি।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ