- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত Perspective of Language Movement of 1952
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি মাইলফলক। বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী এঁটেছিল তা '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা প্রতিহত করেছে। এই ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যেমন রচনা করে তেমনি পরবর্তীকালে বহু ঘটনার উৎস হিসেবে জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথম তার ভাষাকে ধ্বংস করতে হয়। এই তাত্ত্বিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য বাঙালির সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরক্ষণেই বাঙালির ভাষার ওপর হাত দেয়। অফিস-আদালতে ইংরেজি ও উর্দু ব্যবহৃত হতে থাকে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে যে মহান আন্দোলন শুরু হয় তাই ভাষা আন্দোলন নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। বদরউদ্দীন উমর প্রণীত, "পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি" নামক গ্রন্থ স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ (১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণা পত্রে) বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিশ্রুতি ছিল এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করার দাবি করেন তার উল্লেখ আছে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলা ও প্রবঞ্চনা শুরু হয়। পাকিস্তানের ২৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্যটি স্পষ্ট হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল ঔপনিবেশিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও নির্যাতনের এক করুণ ইতিহাস।
ভাষার দাবি নিয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট 'তমদ্দুন মজলিশ' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এ সংগঠনের অপর সদস্যদ্বয় হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (তৎকালীন এস. এম. হলের ভিপি এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) এবং শামসুল আলম (এস, এম, হলের সমাজসেবা সম্পাদক)। তমদ্দুন মজলিশই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন আদালতের ভাষা করার পক্ষে দাবি উত্থাপন করে প্রচার-প্রচারণা চালায়। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংগঠনটি 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই প্রতিষ্ঠানটি নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি' গঠন করে। ক্রমান্বয়ে অনেক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এ আন্দোলনে যোগ দেয়। নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। বহুভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, "পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না, আমাদের যদি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয় তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।" ২ মার্চ দেশের ছাত্রসমাজ বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এবার আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুদ্দিন আলম।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন কমিটির উদ্যোগে আন্দোলন বেগবান হয়। এ পরিষদের নতুন কমিটির আহ্বানে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' পতাকাযুক্ত ছবি, শ্লোগানসহ মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ ও কাজী গোলাম মাহবুব সহ অনেকেই গ্রেফতার হন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩-১৫ মার্চ শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। উক্ত আলোচনা সভায় ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তসমূহ ছিল নিম্নরূপ:
১। ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষা প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।
২। পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এই বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩। ১৯৪৮-এর প্রথম সপ্তাহে পূর্বপাকিস্তান সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
৪। এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল, কলেজগুলোতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।
৫। আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬। সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।.
৭। ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্বপাকিস্তান যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
খাজা নাজিমউদ্দিন আলোচনা সভায় স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কোনো স্বদেশ বিরোধী চক্রান্ত নয়। আন্দোলনকারীদের দাবি যথার্থ। তিনি উক্ত চুক্তিনামায় নিজ হাতে লেখেন যে, He was satisfied that the movement was not inspired by enemies of the state.
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

