• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি

একুশের প্রথম গান ও কবিতা

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে ছাত্ররা "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" স্লোগান দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে এলে পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত ও অনেকে আহত হন। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান এবং আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান। লাশটি ছিল রফিক উদ্দীনের। লাশটি দেখে তার মনে হলো এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। তখনই তার মনে একটি গানের প্রথম দুই লাইন জেগে ওঠে, পরে তিনি গানটি শেষ করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেট "একটি একুশের গান" শিরোনামে প্রকাশিত হয়। গানটি গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজের ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর 'একুশ' নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নগ্ন পায়ে প্রভাতে এই গানটি গেয়ে আমরা শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে থাকি। গানটি হলো-

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবৈশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভ আজ কাঁপুক বসুন্ধরা
দেশে সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পানে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভাইয়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবিকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহিদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি ।
দারুন ক্রোধের আগুন আবার জ্বালাবো ফেব্রুয়ারি

গানটির প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে গানটিতে সুরারোপ করেন। সেই সুরেই গানটি হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরির গান। বর্তমানেও - আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গাওয়া হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সরকার গানটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার "জীবন থেকে নেয়া" ছবিতে গানটি ব্যবহারের পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই গানটির সুনাম আরও বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ ও জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এই গানটির অবস্থান তৃতীয়।
ভাষা আন্দোলনের স্মরণে ১৯৫৪ সালে আবদুল লতিফ লেখেন "ভাষার গান"। গানটি হচ্ছে-

ওরা আমার মুখের ভাষা
কাইড়া নিতে চায়,
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়।
কইতো যাহা আমার দাদায়,
কইছে তাহা আমার বাবায়,
এখন কও দেখি ভাই মোর মুখে কি
অন্য কথা শোভা পায়?
সইমু না আর সইমু না,
অন্য কথা কইমু না,
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
ঐ জানের বদলে রাখুম রে ভাই
বাপ-দাদার জবানের মান।
যে শুনাইছে আমার দেশের
গাঁও- গেরামের গান,
নানান রঙের নানান রসে ভইরাছে তার প্রাণ।
ঢপ-কীর্তন, ভাসান জারি,
গাজীর গীত আর কবি, সারি,
আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা
নাইচা নাইচা কেমন গায়।
তারই তালে তালে হৈ
ঢোল, করতাল বাজে ঐ
বাঁশি কাঁসি খঞ্জিরি, সানাই
কোথায় গেলে দেখতে পাই।

প্রথম কবিতা
ঢাকার কেন্দ্রীয় আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও চৌধুরী হারুনুর রশিদ এবং এম. এ. আজিজকে যুগ্ম আহবায়ক করে চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হরতাল পালিত হয় ৫২'র ২১শে ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদ চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সদস্য খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াছের নিকট পৌঁছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে 'একুশ' নিয়ে প্রথম কবিতা লিখলেন চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। কবিতার নাম ছিল 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'। কবিতাটির' কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো- 

মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী (কবি সাংবাদিক এবং ভাষা সৈনিক)
জন্ম: ৭ই নভেম্বর ১৯২৭; মৃত্যু: ২৩শে ডিসেম্বর ২০০৭।


এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলে
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছোপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
যে শিশু আর কোন দিন তার
পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার
সুযোগ পাবে না
যে গৃহবধূ আর কোন দিন তার
স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ
ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়ায়ে থাকবে না
যে জননী খোকা এসছে বলে
উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর
বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না
যে তরুণ মাটির কোলে লুটিয়ে
পড়ার আগে বার বার একটি
প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে
চেষ্টা করেছিল
সে অসংখ্য ভাই বোনের নামে
আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত
যে ভাষায় আমি মাকে সম্বোধনে অভ্যস্ত
সেই ভাষা ও স্বদেশের নামে
এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাই বোনকে
নির্বিচারে হত্যা করেছে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ