- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস Regional History of Language Movement
ভাষা আন্দোলন বিশ্বের এক নজিরবিহীন ঘটনা। পৃথিবীতে এমন একটিও দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে দেশের মানুষ মায়ের ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশেই মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। বাঙালি জাতিসত্তার মূলভিত্তি হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। বায়ান্নোর পথ ধরে চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তর সালের জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ধাপে ধাপে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। একুশ শিখিয়েছে কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। তাই একুশ মানে অহংকার, একুশ মানে প্রেরণা, একুশ মানে মাথা নত না করা।.
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার আরও অনেকে। পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার সংবাদ বাংলার শহর-গ্রাম-গঞ্জে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে জনসাধারণের বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ, ছাত্ররা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। শ্রমজীবী মানুষও ঘরে বসে থাকেনি। ছাত্র হত্যার বিচারের দাবি গণ দাবিতে পরিণত হয়। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, যশোর, রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন শহরে-বন্দরে ছাত্র, যুবক, সাধারণ মানুষ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ এবং মাতৃভাষার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এখানে অতি সংক্ষেপে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল তার বর্ণনা দেওয়া হলো:
১. চট্টগ্রাম অঞ্চল: তমদ্দুন মজলিশ, চট্টগ্রাম শাখা ভাষা-আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। গ্রাম-গঞ্জে তখন তমদ্দুন মজলিশের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মোমিন রোডস্থ চট্টগ্রাম শাখার তমদ্দুন মজলিশ অফিসে সে সময় প্রায়ই সভা হতো।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক হন সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হন আজিজুর রহমান। আন্দোলন শুরুর সময় মাহবুব-উল-আলম অসুস্থ থাকলে আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সকল শ্রেণি ও পেশাজীবী সংগঠন, কৃষক-শ্রমিক সংগঠন, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও তমদ্দুন মজলিশের প্রতিনিধিদের এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্যদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন জহুর আহমেদ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ, ডা. আনোয়ার হোসেন, চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, হাবিব উল্লা, নুরুজ্জামান, কৃষ্ণগোপাল সেন গুপ্ত, শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ফরিদ আহমদ, ইয়াহিয়াহ খালেদ, এম.এ মান্নান, এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর, ডা. সাইদুর রহমান প্রমুখ।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য জেলার মতো সংগ্রাম পরিষদের আহবানে চট্টগ্রামে সর্বত্র হরতাল, মিটিং, মিছিল এবং লালদীঘি ময়দানে জনসভা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পোস্টার লাগানো হয়। পাড়ায়, মহল্লায়, ক্লাব ও সংগঠনগুলোতে হরতাল সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণহরতাল পালিত হয়। চট্টগ্রামবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করে। পুলিশের বাধাকে উপেক্ষা করে জনগণ হরতাল পালনে এগিয়ে আসে।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র হত্যার সংবাদ ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পৌঁছলে চট্টগ্রামের মানুষ ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে এবং রাস্তায় নেমে আসে। বিকাল বেলা লালদীঘি ময়দান লোকপূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় গণপরিষদের সদস্য এ কে খান জনতার চাপে বলতে বাধ্য হন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে তিনি গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এসময় ঢাকার ছাত্র হত্যার সংবাদ শুনে তরুণ সাহিত্যিক এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী অসুস্থ অবস্থায় লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা "কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি"। এটিই ভাষা আন্দোলনের ওপর লিখিত প্রথম কবিতা। কবিতাটি ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টায় লালদীঘি ময়দানের জনসভায় হারুন-অর-রশীদ পাঠ করেন। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে কবিতাটি ছাপানোর ব্যবস্থা করা হলে পাকিস্তান সরকার প্রেসটি বাজেয়াপ্ত করে। প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। একই সাথে কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ এবং কামাল উদ্দিন আহমদ খানের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এ মামলা ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বিচারে প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবে দেখা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পৃক্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে।
২. রাজশাহী অঞ্চল: রাজশাহী অঞ্চলও ঢাকার আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই এ কর্মসূচি পালন শুরু হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করা হলে তার অংশ হিসেবে ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ভুবন মোহন পার্কে জনসভার আহ্বান করা হয়। জনাব মোহাম্মদ আনসার আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ জনসভায় বক্তৃতা করেন ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল হক, মোসাদ্দারুল হক প্রমুখ। এ জনসভার ২ দিন পর অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মোহাম্মদ আনসার আলীর নেতৃত্বে রাজশাহীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। মোহাম্মদ আনসার আলী ছিলেন তমদ্দুন মজলিশের নেতা। তাঁর বাড়ি নওগাঁ জেলায় হওয়ায় তিনি রাজশাহী ও নওগা জেলায় ভাষা আন্দোলন জোরদার করেন। এজন্য তাকে কারাভোগ করতে হয়।
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলননের কেন্দ্র ছিল রাজশাহী কলেজ। এ কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক বিভিন্নভাবে ভাষা আন্দোলনে সহযোগিতা করেন। এদের মধ্যে বাংলা বিভাগে মুহাম্মদ আবদুল হাই (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন), ড. মুহাম্মদ এনামুল হক (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন) এবং আরবি-ফারসি বিভাগের ড. গোলাম মকসুদ হিলালী প্রমুখ অন্যতম।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে সারা দিনব্যাপী হরতাল এবং বিকেলে ভুবন মোহন পার্কে জনসভা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শাখায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে হরতাল, মিছিল এবং জনসভা হয়। রাজশাহীর নিবিড় গ্রামেও ভাষা আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
৩. খুলনা অঞ্চল: ভাষা আন্দোলনের প্রভাব খুলনা অঞ্চলেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে উত্থাপিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি অগ্রাহ্য হলে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনার দৌলতপুর কলেজে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হামিদ এতে সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন, আমজাদ হোসেন মনসুর আলী, জগদীশ বসু প্রমুখ ছাত্র নেতারা। এসময় খাজা নাজিমুদ্দিনের নিন্দা এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ১০ মার্চ ১৯৪৮ পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। তার মধ্যে শৈলেশ ঘোষ, স্বদেশ বোস, মন্তোষ গুপ্ত, ধনঞ্জয় দাস, তাহমীদ উদ্দীন উল্লেখযোগ্য।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচিকে সফল করতে খুলনার ভাষা কর্মীরা ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের আধারে কে.ডি ঘোষ রোড, যশোর রোড সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগায়। ২১ ফেব্রুয়ারি নেতৃবৃন্দ স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানান। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার সংবাদ খুলনাবাসীরা জানতে পারে ২২ ফেব্রুয়ারি। এ সংবাদে খুলনায় ভাষা আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে খুলনায় শান্তিপূর্ণ সফল হরতাল পালিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় দৌলতপুর বাজারে। এ সভার সভাপতিত্ব করেন আমজাদ হোসেন। মিউনিসিপ্যাল পার্কে অনুষ্ঠিত অপর এক জনসভায় প্রায় দশ হাজার লোক যোগদান করে। স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সফল নেতৃত্ব এবং আন্তরিক উদ্যোগে ৫ মার্চ খুলনা শহর ও শহরতলিতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এভাবে খুলনা অঞ্চল ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখে।
৪. বরিশাল অঞ্চল: ইতিহাসে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বরিশাল অঞ্চল এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে অর্থাৎ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যুক্ত কমিটির আহ্বানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ছদরুদ্দীনের সভাপতিত্বে ভাষাকে কেন্দ্র করে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আখতার উদ্দীন আহমদ, এম ডব্লিউ লফিতুল্লাহ প্রমুখ এতে বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে একটি মিছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে স্লোগান দিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বরিশাল টাউন হলে হাশেম আলী খাঁর সভাপতিত্বে অপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সূত্র: দৈনিক আজাদ: ৫ মার্চ ১৯৪৮।
১৯৪৮ খ্রিষ্টান্দের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে ঐ দিন বরিশালের স্কুল ও কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়। বরিশালের মুসলিম ছাত্রলীগ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন কাজী বাহাউদ্দীন আহমদ। ঐ দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ বরিশালের সকল সভাস্থল বন্ধ করে দেওয়া হলে কোথাও সভা করার জায়গা পাওয়া যায়নি। অবশেষে শহরে ফকির বাড়ি রাস্তার পাশে সভার আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যার পর পুলিশ কাজী বাহাউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক চৌধুরী, আঃ রশিদ, মোহাম্মদ আর্শেদ ও এ.বি.এম আশরাফ আলী খানকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা থানা ঘিরে ফেলে। বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রশাসন গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেয়।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বরিশালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এতে সভাপতি হন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খান। তিনি যুবলীগ সম্পাদক আবুল হাশেমকে আহ্বায়ক করে ২৫ জন সদস্য সংগ্রাম পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন। বরিশালের ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য সংগ্রামী নেতাদের মধ্যে ছিলেন আলী আশরাফ, মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। বরিশালের ভাষা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল বি.এম কলেজের ছাত্র/ছাত্রী বৃন্দ। তাঁরা পৃথক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন চালায়। বি.এম. কলেজ শাখার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন কলেজের তৎকালীন ভি.পি. সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। ঢাকার আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালে সকল বিদ্যালয় ও শহরে হরতাল পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌঁছালে বরিশালবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। রাত ৯টায় শহরে মিছিল হয়। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল ও মিছিল হয়। এ.কে স্কুল ও বি.এম কলেজের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে মিছিলসহ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তারা অশ্বিনী কুমার টাউন হল চত্বরে সমবেত হয়। এ.কে.এম আজহার উদ্দিনের সভাপতিত্বে এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় এ.কে. স্কুল মাঠে শহিদ ছাত্রদের গায়েবোনা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে শহিদ মিনার নির্মাণ করে। শহিদ মিনারে শোকের প্রতীক কালো পতাকা এবং সংগ্রামের প্রতীক লাল পতাকা উত্তোলন করে। এভাবে বরিশাল অঞ্চলকে ভাষা আন্দোলনের সকল স্তরে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
৫. সিলেট অঞ্চল: পত্র-পত্রিকায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে সিলেট ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আল-ইসলাহর আগস্ট সংখ্যায় সম্পাদকীয় লেখা হয়, বাংলা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। এর পর থেকেই সিলেটের মাসিক আল-ইসলাহ এবং সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় ভাষা আন্দোলনের ওপর সংবাদ কখনো আবার প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর সিলেটের মাদ্রাসা হলে মতিন উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিত"। প্রধান আলোচক ছিলেন ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। সমাবেশে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠান শুরুর এক পর্যায় মুসলিম লীগের কর্মীরা আক্রমণ চালিয়ে সভা বন্ধ করে দেয়। ফলে ড. সৈয়দ মুজতবা আলী তার বক্তব্য উত্থাপন করতে পারেননি। পরে কলকাতার চতুরঙ্গ ও সিলেটের আল-ইসলাহ পত্রিকায় তাঁর বক্তব্যটি প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরকারের সাথে ড. সৈয়দ মুজতবা আলীর মতবিরোধ ঘটে এবং তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এরপর ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সিলেট অঞ্চল অনেক কর্মসূচি পালন করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পীর হাবিবুর রহমানকে আহবায়ক করে সিলেটে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র হত্যার সংবাদ সন্ধ্যায় সিলেটে পৌঁছলে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সিলেটবাসী। ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরে হরতাল পালিত হয়। সমস্ত শহরে পোস্টার লাগানো হয়। হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি নওবেলাল পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা বের করে। এদিন নারী সমাজ প্রতিবাদ সভা করে। বিকেলে জিন্নাহ হলে (বর্তমান শহীদ সুলেমান হল) নারী সমাজের আরও একটি সমাবেশ হয়। সিলেটে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত লাগাতার সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট শহরের বাইরেও চলতে থাকে বিশেষ করে গোপালগঞ্জ থানায়, বিশ্বনাথ থানায়, ফেঞ্চুগঞ্জ থানায়, বিয়ানী বাজার থানায় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট হয়।
৬. কুমিল্লা অঞ্চল: ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদে উত্থাপিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি অগ্রাহ্য হয়। ধীরেন্দ্রনাথ কুমিল্লার সন্তান হওয়ায় এবং ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় কুমিল্লায়ও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লাগে। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের সকল পর্বে কুমিল্লার ভূমিকা ছিল অনন্য। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশির বর্বরতা ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা শহরের পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। কুমিল্লা শহর জনশূন্য হয়ে যায়। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। স্থানীয় টাউন হলের জনসভায় এক নজিরবিহীন জনসমাবেশ ঘটে। কুমিল্লার ইতিহাসে এরকম জনসভা কখনো ঘটেনি।
এভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগা, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নাটোর, কুড়িগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পঞ্চগড়, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ঢাকাকে অনুসরণ করে ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম সংঘটিত হয়।
ভাষার দাবিতে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি এখানে তুলে ধরা হলো:
১. ২২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত জনসভায় একটি "রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" গঠিত হয় এবং একই দিনে বিকালে স্থানীয় টাউন হলে জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলার মুসলিম লীগ সভাপতি ফখরুদ্দীন আহমদ। এ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদসহ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয়।
২. ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘট, হরতাল, মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয়।
৩. ২৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভায় ছাত্র হত্যার এবং জনসাধারণের ওপর পুলিশি নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
৪. যশোর জেলায় শিরোলিস্তান গ্রামে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবে পুলিশি নির্যাতন এবং ছাত্র হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এ জনসভা থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। এ জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

