- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তানি আমলে বাংলা : ভাষা আন্দোলন ও এর গতিপ্রকৃতি
শহিদ মিনারের ইতিকথা
শহিদ মিনার মহান ভাষা আন্দোলন ও বীর শহিদদের স্মৃতি চিরঅম্লান করে রাখার জন্য এবং বাঙালির প্রতিবাদের গৌরবোজ্জ্বল রক্তাক্ত ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেওয়ার স্মৃতির মিনার। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষা করার জন্য যেসকল ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছিলেন এবং যাঁরা জীবন বাজি রেখেছিলেন তাদের স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এবং অধিকার আদায়ে প্রেরণা জোগাতেই শহিদ মিনারের সৃষ্টি।
প্রথম শহিদ মিনার: ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা মেডিকেল ছাত্র হোস্টেলের বারো নম্বর শেডের পূর্বপ্রান্তে রাতারাতি প্রথম শহিদ মিনার তৈরি করেন। সেখানেই প্রথম শহিদ হয়েছিল রফিক উদ্দিন আহমেদ। শহিদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া। এর ডিজাইন করেন ডা. সাইদ হায়দার ও ডা. বদরুল আলম। তদারকিতে ছিলেন মির্জা মাজহারুল ইসলাম ও জি.এস শরফুদ্দিন। মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু, সিমেন্ট এ কাজে ব্যবহার হয়। ভোর হওয়ার পর কাপড় দিয়ে মিনারটি ঢেকে দেওয়া হয়।
২৪শে ফেব্রুয়ারি শহিদ শফিউর রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন। শহিদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদগুলোতে পাঠানো হয়। "শহিদ বীরের স্মৃতি" শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহিদ মিনারের খবর। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় শহিদ মিনারটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ঐ দিনই পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং রাতের মধ্যেই প্রথম শহিদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন 'স্মৃতিস্তম্ভ' নামে এই কবিতাটি-
স্মৃতিস্তম্ভ
স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুন টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার জাগরী
চারকোটি পরিবার
এ- কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ- কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণ লেখায়
পলাশের আর
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
শহীদদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর।
দ্বিতীয় ধাপে শহিদ মিনার বায়ান্ন সালে শহিদ মিনার ভাঙার দুই বছর পর ১৯৫৪ সালে একুশের শহিদদের স্মরণে নতুন শহিদ মিনার তৈরি করা হয়।
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টির মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন করে শহিদ মিনারের কাজ শুরু হয় এবং একটানা কাজ চালিয়ে ১৯৫৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের ভিত্তি, মঞ্চ এবং তিনটি স্তম্ভ তৈরি সমাপ্ত হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে শিল্পী হামিদুর রহমানকে শহিদ মিনার থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে থেমে যায় শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ। অতঃপর ঐবছরের ২৭শে অক্টোবর জারি করা হয় সামরিক শাসন। আটান্ন থেকে বাষট্টি পর্যন্ত এই অসমাপ্ত শহিদ মিনারেই জনতা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহিদদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে এবং সকল প্রকার অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য মিলিত হয়েছে এবং শপথ করেছে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য একটি কমিটি করে দেন। সেই কমিটি শিল্পী হামিদুর রহমানের সাতান্ন সালের শহিদ মিনারের নকশা সুপারিশ করেন। সেই অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত এই শহিদ উদ্বোধন করেন শহিদ আবুল বরকতের ৭২ বছরের বয়স্ক মা হাসিনা বেগম। তেষট্টি থেকে একাত্তর এই নয় বছর ঐ শহিদ মিনারই ছিল বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের শপথ গ্রহণের পীঠ স্থান। আর তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাতে গণহত্যা চালানোর পরে ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গোলাবর্ষণ করে শহিদ মিনারটি গুড়িয়ে দেয়।
বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি আবার শহিদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু করে। উক্ত কমিটি শিল্পী হামিদুর রহমানের পেশকৃত নকশা ও পরিকল্পনাই অনুমোদন করেন, যা ছিল সাতান্ন সালের নকশা ও পরিকল্পনা অনুরূপ। হামিদুর রহমানের নকশায় বর্তমানে শহিদ মিনার তিনস্তর বেদির ওপর মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। ৫টি স্তম্ভের মাঝখানে রয়েছে ঈষৎ অবনত সবচেয়ে বড় একটি স্তম্ভ। এর দুপাশে রয়েছে দুটি করে চারটি স্তম্ভ। মাঝখানের বড় ঈষৎ অবনত স্তম্ভটি স্নেহময়ী মা এবং দুপাশে ছোট স্তম্ভ চারটি সন্তানের প্রতীক হিসেবে শহিদ মিনারকে মনে করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহিদ মিনারটিই বর্তমানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। অবিকল নকশায় দেশের সকল জেলা শহরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার রয়েছে। দেশের বাইরে প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয় জাপানে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

