- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- শিল্প বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
শিল্প বিপ্লব
প্রাক-বিপ্লব ইংল্যান্ডের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
অর্থনৈতিক অবস্থা: শিল্পবিপ্লবের পূর্বে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল দুর্বল প্রকৃতির। বিপ্লবপূর্ব যুগে কৃষিব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। সামন্ততান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা কৃষির উন্নতির ক্ষেত্রে উপযুক্ত ছিল না। কৃষিভূমিগুলো ছিল ছড়ানো ও অবিন্যস্ত, যা সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করা হতো। চাষাবাদযোগ্য ভূমি ৩টি বড় মাঠে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি মাঠে অর্ধএকর বা এক একর এভাবে জমির ফালি থাকত। কৃষকরা এসব জমি চাষাবাদ করত। কৃষিব্যবস্থা এত অনুন্নত ছিল যে, তিন বছর পর পর ৩টি ফসল উৎপাদন করা হতো। অর্থাৎ প্রথম বছর গম, দ্বিতীয় বছর বার্লি ও তৃতীয় বছর জমি ফেলে রাখা হতো। খোলা মাঠ পদ্ধতি ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রতিবন্ধক। শিল্পবিপ্লবপূর্ব যুগে দৈহিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনপ্রক্রিয়া চালু ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে খরস্রোতা নদীর স্রোতের সাহায্যে অথবা তীব্র বায়ুপ্রবাহের দ্বারা চাকা ঘুরিয়ে শিল্পদ্রব্য তৈরির জন্য যন্ত্র চালু হয়। যেখানে এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল না, সেখানে পুরো দৈহিক শ্রমের দ্বারা শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করা হতো। সেই সময় বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় সুতা কাটা ও কাপড় বুননের জন্য কাজ কারখানায় না করে বাড়িতে সম্পন্ন করা হতো। এ কারণে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে পারিবারিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এ উৎপাদনব্যবস্থায় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন ছিল সীমাবদ্ধ ও প্রকৃতির
খেয়ালের উপর নির্ভরশীল।
ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য আর্থার ইয়াং নামের একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে নতুন পদ্ধতি চালু করেন। এর ফলে কৃষকরা সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করে। পার্লামেন্টের আইন দ্বারা ও আর্থার ইয়াং-এর প্রচারণায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমির ফালিগুলোকে একত্রিত করে বৃহৎ খামারে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে কৃষি উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ষোড়শ শতকের কৃষির বেড়া আন্দোলন কৃষিবিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করে।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের অগ্রগতির পেছনে বস্ত্রশিল্পই ছিল প্রধান সহায়ক। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম বস্ত্রশিল্পের যন্ত্র আবিষ্কার হয়। হবস বান এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, "ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব বলতে একমাত্র বোঝায় বস্ত্র, বস্ত্র এবং বস্ত্র।" বস্ত্রশিল্পের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে শিল্পের যাত্রা গতি লাভ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে বস্ত্র উৎপাদনকারী তাঁতিরা নিজেরা উৎপাদন ও বাজারজাত করত। কিন্তু একপর্যায়ে কিছু ধনিক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারজাতকরণের দায়িত্ব নিজেরা নেয়। ফলে বস্ত্র উৎপাদনকারী তাঁতিরা সাধারণ শ্রমিকে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে এই ধনিক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা তাঁতিদের পৃথকভাবে উৎপাদন করতে না দিয়ে নিজেরা অর্থ বিনিয়োগ করে উৎপাদন শুরু করে। ফলে ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশ লাভ করে।
মূলত ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব বিকাশের ক্ষেত্রে কৃষির ভূমিকা ছিল অন্যতম। কৃষি ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করায় উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কৃষিদ্রব্য শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ফলে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল সহজলভ্য হয়। কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তারা শিল্পদ্রব্য কিনতে সক্ষম হয়, যা শিল্প উৎপাদনের জন্য ইতিবাচক ছিল।
ইংল্যান্ডে লোকসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এই বাড়তি লোক কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে যায়। এ লোকজন শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। গ্রামাঞ্চলে এনক্লোজার বা ভূমি বেষ্টনী প্রথার প্রসার ঘটলে বড় জমির মালিকরা বেষ্টনী আইনের সাহায্যে ছোট জমিগুলো গ্রাস করে। ফলে বহু চাষি ভূমিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়। এই ভূমিহীন কৃষকরা শহরে এসে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। শিল্পবিপ্লবপূর্ব যুগে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক অবস্থা থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন হয়।
সামাজিক অবস্থা: অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে ইংল্যান্ডের মানুষের সামাজিক অবস্থা ছিল সাধারণ প্রকৃতির। এই সময়ে তাদের জীবন-জীবিকার কিছুটা পরিবর্তন হয়। এ সময় ইংল্যান্ডে মাথাপিছু আয় ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ১৭৩০-১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে জনসংখ্যা ৭% বাড়ে। একই সঙ্গে খাদ্য ও কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন ১০% বাড়ে। জনসংখ্যার সাথে সাথে খাদ্য ও কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংল্যান্ডের জনগণের সচ্ছলতা বেড়ে যায়। কৃষিতে বৈজ্ঞানিক চাষপদ্ধতির কারণে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এই উদ্বৃত্ত খাদ্যসামগ্রী শিল্প শ্রমিকরা অল্প দামে কিনতে পারত। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্পের প্রসারের ফলে ইংল্যান্ডের জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। ইংল্যান্ডে শিল্পের প্রসার ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিউরিটান সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংল্যান্ডে অন্যান্য জাতির তুলনায় পিউরিটান সম্প্রদায় ছিল কঠোর পরিশ্রমী। ক্রমওয়েলের পতনের পর এই সম্প্রদায় রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্প সংগঠনে মনোনিবেশ করে। ইংল্যান্ডে পেনসন পার্লামেন্ট আইন করে পিউরিটান সম্প্রদায়কে চাকরি, শিক্ষকতা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক জীবিকা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এসব পেশাবঞ্চিত পিউরিটান শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারে দৃঢ়তার সাথে আত্মনিয়োগ করে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এভাবে ইংল্যান্ডের সামাজিক জীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসে।
রাজনৈতিক অবস্থা: শিল্প বিকাশ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তৎকালে ইংল্যান্ডে বিপ্লব সংঘটিত হলেও তা ইংল্যান্ডের মাটি থেকে অনেক দূরে হয়েছিল। এজন্য ইংল্যান্ডে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে কোনো প্রকার বাধা ছিল না। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত যেসব রাজা ইংল্যান্ড শাসন করেছে তারা সবাই ছিল শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি উদারনৈতিক। ১৪৫৫-১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে গোলাপের যুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। টিউডর রাজাগণ ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই অভিজাত সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সৃষ্টিতে সহায়তা করেন। তারা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। ইংল্যান্ডে সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে অ্যাংলিকান চার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রোমান পোপের আধিপত্য বিলুপ্ত হয়। এভাবে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব খর্ব হলে এ ধর্মের অনুসারীগণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পেশা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। ফলে তারা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রসারে মনোনিবেশ করে। ইংল্যান্ডের প্রজাকল্যাণকামী শাসকদের সহযোগিতায় ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব দ্রুত প্রসার লাভকরে। ফলে ইংল্যান্ডে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে টিউডর যুগে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা, স্টুয়ার্ট যুগেও ছিল। মূলত হেনোভার যুগে রাজনৈতিক অবস্থার কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটে। ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম বস্ত্রশিল্পের যন্ত্র আবিষ্কার হয়। কিন্তু অবিরামভাবে যন্ত্রগুলো চালানোর ব্যবস্থা ছিল না। এ সমস্যা দূর করার জন্য জেম্স ওয়াট ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন; যেখানে যতক্ষণ দরকার ততক্ষণ এ বাষ্পীয় ইঞ্জিন দ্বারা শিল্প উৎপাদনের যন্ত্রগুলো চালনার ফলে শিল্পজ উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। উৎপাদনব্যবস্থার এ বিপ্লব বৃহত্তর শিল্প-বাণিজ্যের বিপ্লব এবং পরিণামে সমাজবিপ্লব ঘটায়। কাজেই "প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে শিল্প উৎপাদনের এ বিরাট ও গভীর মূল পরিবর্তনকেই শিল্পবিপ্লব বলা হয়।" কোনো সমাজে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কয়েকটি পরিবর্তন দেখা গেলে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়-
১। কুটির শিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রচালিত পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশ।
২। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে মুনাফা লাভের ব্যবস্থা।ব্যবস্থা।
৩। কারখানায় শ্রমিক মজুরির সাহায্যে উৎপাদনের ব্যবস্থা।
৪। পণ্য উৎপাদনের জন্য শ্রমিক ও কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা।
৫। মূলধন সরবরাহের জন্য অর্থনৈতিক সংস্থা অর্থাৎ ব্যাংকের উদ্ভব।.
৬। যন্ত্র চালনার জন্য বাষ্পের প্রয়োগ ও পরিবহনব্যবস্থার অগ্রগতি।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

