• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • শিল্প বিপ্লব
শিল্প বিপ্লব

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

শিল্প বিপ্লব

শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপ

ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব ছিল একটি ধীর, মন্থর ও বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। শুধু ব্রিটেনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে নয় বরং ইউরোপের ইতিহাসে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। যে সময় ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব শুরু হয় (১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে), সে সময়ে ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশ ব্রিটেনের মতো বা এর চেয়ে বেশি উন্নত ছিল। শিল্পবিপ্লব সৃষ্টির সহায়ক উপাদান ছিল বলেই ইংল্যান্ডে বিপ্লবের সূচনা হয়; যা ক্রমে ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয় ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসনামলে। যদিও সপ্তদশ শতকে ফরাসি মন্ত্রী কোলবার্ট ফ্রান্সে কৃষিবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লব প্রসারের প্রচেষ্টা নেন, কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও স্বৈরশাসনের চাপে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়নি। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের বুরবোঁ শাসকরা শিল্পপতিদের সহায়তায় ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব বিস্তারের উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে ফ্রান্সে লোহা ঢালাইয়ের কারখানা স্থাপন করা হয়, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মডেল তৈরি করা হয় এবং ইংল্যান্ড থেকে প্রকৌশলীদের এনে যন্ত্রশিল্প স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এতসব চেষ্টার পরও ব্যাপক অর্থে ফ্রান্সে শিল্পের বিস্তার ঘটেনি। নেপোলিয়নের 'মহাদেশীয় অবরোধ' ব্যবস্থার ফলে ইউরোপের বাজারে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রকৃত অর্থে শিল্পবিপ্লব হয়নি। ফ্রান্সে দেরিতে শিল্পবিপ্লব ঘটার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় যে-১২

১। খাদ্য উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মূলধনী সংস্থার উদ্ভব, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রভৃতি যেসব উপাদানের উপর নির্ভর করে শিল্পবিপ্লব ঘটে, সে উপাদান ও পরিবেশ অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে ছিল না। ফ্রান্সের অভিজাতরা ছিল রক্ষণশীল, কায়িক শ্রমবিমুখ। তারা শিল্প-বাণিজ্যের কাজকে ঘৃণা করত। সামন্তপ্রথার দরুন পৈতৃক জমিদারির অধিকারকে সম্মানজনক মনে করত।

২। ফ্রান্সের বুর্জোয়া ও ধনী ব্যবসায়ীদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির সমতুল্য ছিল। এজন্য ফ্রান্সের সামাজিক পরিবেশ ও মধ্যযুগীয় মানসিকতা শিল্প গঠনের প্রতিকূল ছিল।

৩। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফরাসি উপনিবেশগুলো হাতছাড়া হওয়ায় কাঁচামালের সরবরাহে ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে বাধা পড়ে। ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজগুলো ব্রিটিশ নৌবহর দ্বারা ধ্বংস হলে ফ্রান্সের। বৈদেশিক বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়, যার ফলে শিল্পবিস্তার ঘটেনি।

৪। মহাদেশীয় ব্যবস্থা চালুর সময় ইউরোপের বাজারে ফ্রান্সের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার নেপোলিয়নের পতনের সাথে সাথে ফ্রান্সের আধিপত্য খর্ব হয়। শিল্প-কারখানা চালু রাখার জন্য প্রচুর কয়লার দরকার হতো, ফ্রান্সে কয়লার সরবরাহে সীমাবদ্ধতা থাকায় শিল্প উৎপাদনে বিলম্ব ঘটে।

৫। রেলপথের বিস্তার না হওয়ায় ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কারে ফ্রান্সে বিলম্ব ঘটায় ইংল্যান্ডের সমসাময়িককালে ফ্রান্সে শিল্পের বিস্তার সম্ভব হয়নি।

৬। মূলধন সরবরাহের ঘাটতি থাকায় ফ্রান্সের শিল্পবিপ্লব দেরিতে শুরু হয়।

তৃতীয় নেপোলিয়ন (১৮০৮-১৮৭০) ফ্রান্সে শিল্প ব্যাংক স্থাপন করে শিল্পপতিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেন। সংরক্ষণনীতির দ্বারা বিদেশ থেকে আমদানি দ্রব্যের উপর শুল্ক চাপিয়ে দিয়ে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পর রেলপথের প্রসার ঘটলে এবং রাজনৈতিক স্থিতি এলে ফ্রান্সে শিল্পের গতিশীলতা আসে। তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসনকালে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের 'স্বর্ণযুগ' শুরু হয়।

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে অন্তঃশুল্ক গিল্ড প্রথা ও শিল্পের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ লোপ পায় এবং বিপ্লবের আঘাতে ফ্রান্সের মধ্যযুগীয় সমাজ ভেঙে যায়। নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা ব্যর্থ হলেও ফ্রান্সের আধুনিকীকরণের ব্যবস্থাগুলো অক্ষুণ্ণ থাকে। ফলে শিল্পবিপ্লবের উপযোগী সামাজিক পটভূমি তৈরি হয়, যদিও ১৮১৫-৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের প্রসার ছিল মন্থর। ফ্রান্সে যন্ত্র দ্বারা বস্ত্রশিল্প তৈরি শুরু হয় ১৮৩৭খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে দ্বিতীয় সাম্রাজ্য স্থাপিত হলে শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। ফ্রান্সে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে। উক্ত সময়ের মধ্যে ফ্রান্সের রেলপথ ১০ হাজার মাইলে দাঁড়ায় এবং ব্যাপক হারে কয়লা ও লোহার উৎপাদন বাড়তে থাকে। লায়ন্স শহরকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে 'রেশমশিল্প গড়ে ওঠে। ফ্রান্স তার ঔপনিবেশিক অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানত শিল্প গঠন করে। বিলাসী রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে ফ্রান্স বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।

কৃষিক্ষেত্রে ফ্রান্সের বিপ্লব ব্রিটেনের মতো ছিল না। ব্রিটেনে বেষ্টনী আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহৎ পুঁজিবাদী খামার গড়ার ঝোঁক দেখা যায়, অপরদিকে ফ্রান্সে বৃহৎ খামার ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে পরিণত করে কৃষকদের মালিকানা দিয়ে আবাদ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে কৃষিতে ব্রিটেনের মতো দ্রুত উৎপাদন ফ্রান্সে ঘটেনি। আবার ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ ফ্রান্স-জার্মানি যুদ্ধের পর ফ্রান্স শিল্প ও খনিসমৃদ্ধ অঞ্চল ছেড়ে অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে ফ্রান্সের শিল্পের।

জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব'

ব্রিটেনের শিল্প উন্নয়ন যখন এক চূড়া থেকে পরবর্তী উন্নত চূড়ায় পৌছে যাচ্ছিল, তখন জার্মানি ছিল সমস্যাসংকুল ৩৮টি রাজ্যে বিভক্ত এক কৃষিপ্রধান অঞ্চল। অথচ সেই জার্মানি এক শতকের মধ্যে (১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বী, শিল্প-বাণিজ্যে শক্তিধর, সামরিক বলে বলীয়ান এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। জার্মানির অগ্রগতির মূলে ছিল শিল্পশক্তি, বিজ্ঞানের দক্ষতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এজন্য অর্থনীতিবিদ কেইন্স বলেন, "রক্ত ও লৌহের দ্বারা নয়, কয়লা ও লৌহের দ্বারাই জার্মানির ঐক্য ও প্রাধান্য অর্জিত হয়।" জার্মানির এ চমকপ্রদ অগ্রগতিকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা- ১৮১৫-৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাক-ঐক্যবদ্ধ জার্মানির শিল্প গঠনের যুগ এবং ১৮৭০-১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ জার্মানির শিল্প গঠনের যুগ। প্রথম পর্যায় ছিল বিলম্বিত, মন্থরগতি এবং জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে উন্নয়নের গতি ছিল সমতাহীন। দ্বিতীয় পর্যায়ের ঐক্যবদ্ধ জার্মানির শিল্পের উন্নয়ন ছিল অতিদ্রুত ও তুলনাহীন।
১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে জার্মানিতে শিল্প গঠনে বাধা ছিল প্রচুর। ব্রিটেনের তুলনায় জার্মানি ছিল অনগ্রসর কৃষিপ্রধান দেশ। জার্মানিতে শিল্প গঠনে প্রধান অন্তরায় ছিল নিম্নরূপ:

১। জার্মানির রাজনৈতিক বিভাজন তথা ৩৮টি রাজ্যে বিভক্ত থাকায় কাঁচামাল সরবরাহে অসুবিধা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় কোনো শুল্কনীতি না থাকায় এবং বিভিন্ন রাজ্যে শুল্ক হারে অসমতা থাকায় শিল্পোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

২। কেন্দ্রীয় মুদ্রা না থাকায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য রপ্তানিতে সমস্যা দেখা দেয়।

৩। কেন্দ্রীয় আইন না থাকায় শুল্ক ও বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করা কষ্টকর ছিল।

৪। যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা ব্রিটেনের মতো গড়ে না ওঠায় জার্মানিতে শিল্পের অগ্রগতি মন্থর হয়।

৫। জার্মানির কোনো উপনিবেশ না থাকায় শিল্প উৎপাদনের প্রেরণা জার্মানদের মধ্যে দেখা দেয়নি।

৬। মূলধনের অভাবে শিল্প গঠনের কাজ জার্মানিতে পিছিয়ে যায়।

এত অসুবিধা সত্ত্বেও জার্মানিও শিল্পায়নের পথে ধাবিত হয়। নেপোলিয়নের বিভিন্ন সংস্থা জার্মানির সমাজে আধুনিক চিন্তাধারা ও জীবনবোধ তৈরিতে সহায়ক পটভূমি তৈরি করে।

জার্মানিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

জার্মানিতে শিল্পায়নের প্রধান বাহন ছিল রেলপথের নির্মাণ। ডেভিড টমসনের মতে, "ব্রিটেন ও বেলজিয়াম প্রভৃতি অধিকতর শিল্পায়ত দেশ অপেক্ষা জার্মান জীবনধারার উপর জার্মান রেলপথ নির্মাণের প্রভাব ছিল অনেক বেশি বৈপ্লবিক ও গভীর।" জার্মানির অর্ধ-গ্রামীণ নগরগুলো রেলপথ দ্বারা সংযুক্ত হয়। গ্রামের মানুষ সংকীর্ণ, কুসংস্কারময় জীবনবোধ ত্যাগ করে। রেলপথই জার্মানির সংহতি ও অর্থনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে। জার্মান বুর্জোয়া ও বণিক শ্রেণি জার্মানির ১৮টি রাজ্য নিয়ে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম শুল্ক সংঘ গঠন করে। জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে মালামাল পরিবহনে শুল্ক সংঘ অগ্রণী ভূমিকা নেয়। উক্ত সময়ের মধ্যে জার্মানির গৌরব লোহা ঢালাই ও অস্ত্র তৈরির কারখানা ক্রাপ কোং স্থাপিত হয়।

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জার্মানির শিল্পের বিকাশ শুরু হয় এবং পূর্ণতা পায় ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ। এই ২০ বছরে জার্মানির শিল্পায়নের অগ্রগতি ছিল অতুলনীয়। এ সময় ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে ৬,০০০ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। জার্মানির শিল্প প্রসারে বেসরকারি মূলধনীরাই মুখ্য ভূমিকা নেয়। সরকার শুধু আইনি পরামর্শের দ্বারা সংহতি সাধন করে। বিবিধমুখী ব্যাংকগুলো শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করে। জার্মানিতে শিল্প স্থাপনে ট্রাস্ট, কম্বাইন ও কার্টেল গঠনে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে টেলিগ্রাফ চালু হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে গতিশীলতা আসে। লোহা ও কয়লা উৎপাদনে জার্মানি ব্রিটেনের প্রায় সমকক্ষ হয়ে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যেই জার্মানি রসায়নশিল্পে বিশ্বে শ্রেষ্ঠ স্থান পায়।

জার্মানির শিল্প বিকাশে এ অসাধারণ সাফল্যের মূলে ছিল নিবেদিত ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জাতীয়তাবাদ ও ইউরোপে সেরা জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের বাসনা। জার্মানদের কর্মদক্ষতা ও সৃজনী প্রতিভা শিল্প উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে নিয়ে আসে।

রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব' 

ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের অনেক পরে রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব ঘটে। জার শাসনামলে রাশিয়া ছিল এক অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ। বলশেভিক বিপ্লবের পর রুশ সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তবেই রাশিয়ায় প্রকৃত শিল্পায়ন শুরু হয়। ব্রিটেনে যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটে, রাশিয়ায় সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় শিল্পের প্রসার ঘটে। রাশিয়ায় এত দেরিতে শিল্পবিপ্লব শুরুর কারণ হিসেবে জার সরকারের রক্ষণশীল নীতি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, সার্ফ প্রথা প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়। রাশিয়ার ভূমিদাসদের স্বাধীন অর্থনৈতিক জীবন গঠনের ক্ষমতা ছিল না। জার সরকার উপেক্ষা করায় ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি।

লোহা, কয়লা ইত্যাদি মূল শিল্পের বিকাশ ছাড়া শিল্পবিপ্লব সম্ভব নয়। জার সরকার চিনি, কাপড় ইত্যাদি শিল্প গঠনে আগ্রহ দেখায়। জারতন্ত্রে শিল্পবিস্তারের অভ্যন্তরীণ সংগঠন ছিল না। রুশ দেশে নিরক্ষতার হার ছিল বেশি; ৮০% লোক ছিল কৃষিজীবী। সরকারি ও সামন্ত কর প্রদানের পর লোকের হাতে উদ্বৃত্ত কোনো অর্থ থাকত না, যা দ্বারা তারা শিল্পদ্রব্য ক্রয় করতে পারে। রাশিয়ায় দেরিতে শিল্পায়ন শুরু হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দক্ষ মজুরের অভাব। ভূমিদাসপ্রথা উচ্ছেদের পর রাশিয়ায় শিল্পজীবী দক্ষ শ্রমিকের উদ্ভব হয়। মধ্যযুগীয় ঘোড়ার গাড়ির মতো পরিবহনব্যবস্থার দ্বারা শিল্প গঠন সম্ভব নয়। জার সরকার আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ও বৈদেশিক যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকত; শিল্প প্রসারের বৈষয়িক উন্নতির দিকে সরকারের নজর ছিল না। সর্বোপরি রাশিয়ার অন্তঃশুল্ক ব্যবস্থা ও মূলধনী সংগঠনের অভাব শিল্পায়ন বিলম্বের অন্যতম কারণ ছিল।

রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

রাশিয়ার উপরিউক্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের পর; মূলত শিল্পের প্রসার তখন থেকেই শুরু। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের 'ভূমিদাস মুক্তি আইনকে' পুঁজিবাদী শিল্প গঠনের প্রথম পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়ার মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসরা গ্রাম ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে শহরে চলে আসায় এরাই শিল্প শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়। তবে এরা ছিল মন-মানসিকতায় আধা শ্রমিক আধা কৃষক। ফলে শিল্প শ্রমিকের কাজকে ধ্যান-জ্ঞান করেনি। তবে ভূমিদাসপ্রথা উচ্ছেদের ফলে সামন্ত শ্রেণি যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তেমনি মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হয়। শিল্প গঠনে এ শ্রেণির ভূমিকা ছিল সর্বাধিক।

ভূমিদাসপ্রথা উচ্ছেদের ফলে জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। জোতদার শ্রেণি জমির মালিক হলে জমির উৎপাদন আরও বাড়ে। কৃষির উৎপাদন বাড়ার ফলে দেশে কাঁচামাল, সম্পদ ও মূলধন জমা হয় এবং শিল্পবিপ্লবের সামাজিক ভিত্তি গঠিত হয়। এ সময় জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে। জনসংখ্যার একাংশ নগরমুখী হয় ও শিল্প শ্রমিকে পরিণত হয়। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার শিল্প প্রসারের নীতি গ্রহণ করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় শিল্পের প্রসার হলেও রাশিয়ায় শিল্পের প্রসার ঘটে সরকারের ভূমিকায়। সরকার ঋণদান দ্বারা অথবা বৈদেশিক ঋণ জোগাড় করে শিল্প স্থাপনে মূলধন সরবরাহ করে। ফ্রান্সের ব‍্যাংকগুলোর মূলধন রাশিয়ার রেলপথ নির্মাণে ও জার্মানির মূলধন অন্যান্য শিল্প নির্মাণে নিযুক্ত হয়। কাউন্ট উইটি ভারী শিল্প গঠনে নজর দেন। অস্ত্রশিল্প নির্মাণে সরকার থেকে উৎসাহ দেওয়া হয়। কাউন্ট কৃষকের উপর শিল্প কর চাপিয়ে সেই অর্থ শিল্পে বিনিয়োগ করেন। রাশিয়ার মতো বিশাল দেশে মালামাল পরিবহনের সমস্যা ছিল জটিল। ইংল্যান্ডের মতো মাল পরিবহনের সুযোগ রাশিয়ার ছিল না। এজন্য রেলপথ নির্মাণ ছিল রাশিয়ার শিল্পায়নের চাবিকাঠি। বিখ্যাত ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গকে প্রশান্ত মহাসাগরের ভ্লাদিভোস্টক বন্দরের সাথে সংযুক্ত করে। রাশিয়ার উৎপাদিত পণ্যের বাজার ইউরোপে না থাকায় রেলপথযোগে তা মঙ্গোলিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় পাঠিয়ে বিক্রি করা হতো। যেহেতু রাশিয়ায় প্রযুক্তিবিদ্যা ছিল না, তাই জার সরকার পশ্চিমা যন্ত্রবিদদের সহায়তায় বিশালকায় কারখানা তৈরি করে।

ইতালিতে শিল্পবিপ্লব

অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইতালি ছিল প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশ। অবশ্য এ শতকেই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ইতালিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পড়ে। প্রত্যক্ষভাবে কাঁচামালের উৎস হিসেবে ইংল্যান্ডের শিল্পগুলোতে কাঁচা ও বোনা সিল্ক রপ্তানি করত। ফলে ইতালিতে ক্ষুদ্রকায় সিল্ক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল ইতালির শিল্পবিপ্লবের প্রথম পর্যায়। ইতালির শিল্পায়নে পরোক্ষভাবে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় কিছু কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এবং ইংল্যান্ডের অনুরূপ শিল্প স্থাপন করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। ইতালির জাতীয় ঐক্য সম্পন্ন হয় ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ। এ সময় রেলপথ নির্মাণ ও শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু উপযুক্ত কয়লা ও লোহার অভাবে বৃহৎ শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিল্পের এ ধীরগতি চলে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শিল্পে আকস্মিক অগ্রগতি শুরু হয়। ১৮৯৬-১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালকে ঐতিহাসিক কাফাগ্লা ইতালির শিল্প উন্নয়নের যুগ বলে অভিহিত করেছেন। এ অগ্রগতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এ সময়ে জীবনযাত্রার মান হ্রাস না করে শিল্পের প্রসার ঘটে, যা ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ইতালীয় শিল্পের অগ্রগতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা করা। সাধারণত শিল্প প্রসারের প্রথম অবস্থায় বৈদেশিক খাতে ঘাটতি দেখা দেয়। ইংল্যান্ড এই ঘাটতি পূরণ করেছিল ভারতের সম্পদ লুট করে ও উপনিবেশগুলো থেকে সন্তায় কাঁচামাল খরিদ করে। ইতালীয় শিল্প উন্নয়নে তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এর দ্বিমুখী উন্নয়ন। অর্থাৎ পুরাতন শিল্প কাঠামো থেকে লাভ অর্জন এবং নতুন কাঠামো থেকেও লাভ অর্জন। এ যুগেই ইতালির ইস্পাত ও রসায়নশিল্পের প্রসার ঘটে এবং উন্নতমানের যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।

বেলজিয়াম ও শিল্পবিপ্লব

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই, বেলজিয়ামে শিল্প উন্নয়নের সূচনা হয় এবং কয়েক দশকের মধ্যে এর গতিধারা দ্রুত হয়। বেলজিয়ামে শিল্পায়নের মূলে ছিল উন্নতমানের কয়লাখনির আবিষ্কার। সরকারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর কয়লার জোগান ও জাতীয় তৎপরতা বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লবের সূচনা করে, যার সাথে ইংল্যান্ডের তুলনা করা যায়। ইংরেজ পুঁজিপতি ও যন্ত্রবিদদের সাহায্যে সেখানে বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। বেলজিয়াম ছিল সর্বাধিক জনবহুল দেশ। অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল নগরবাসী ও ব্যবসায়ী। রেলপথ সম্প্রসারণে ইংল্যান্ডের তুলনায় বেলজিয়ামের অগ্রগতি ছিল অধিক। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে বেলজিয়ামের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে বেলজিয়াম ইউরোপের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।

স্পেনে শিল্পবিপ্লব

ষোলো শতকে স্পেন উপনিবেশ স্থাপনে এগিয়ে গেলেও সম্পদ আহরণ করার কোনো প্রয়াস স্পেনের ছিল না। ফলে শিল্পবিপ্লব ঘটানোর মতো আর্থসামাজিক ভিত্তি স্পেনে গড়ে ওঠেনি। স্পেনের রাজকোষে তাই অর্থ বাড়েনি। স্পেনের রাজশক্তি ইউরোপের বাজার থেকে ঋণ করতে বাধ্য হয়। স্পেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজার ঋণপত্র কিনে রাজাকেই ধার দিত। যেসব ঋণদায়ী কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো ছিল বণিকী ব্যাংক। ফলে শিল্প স্থাপনায় স্পেন খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। উনিশ শতকে রেল শিল্পে বিদেশি কোম্পানি যথেষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করলেও পণ্য সরবরাহের অভাবে এ খাত ততটা লাভজনক হতে পারেনি। তবে স্পেনে সত্যিকার শিল্পের প্রসার ঘটেছিল ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে। উর্বর জমি, পুঁজি ও খনিজ সম্পদের অভাবই স্পেনে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব না পড়ার অন্যতম কারণ বলে অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন।

উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ইউরোপজুড়েই বিদ্যমান ছিল। ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই দেরিতে হলেও শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছিল।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ