• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • শিল্প বিপ্লব
শিল্প বিপ্লব

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

শিল্প বিপ্লব

শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ইংল্যান্ড

শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। শিল্পবিপ্লব ব্রিটেনের সর্বক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। এ বিষয়ে হারভার্ড স্কলার আর. টি. গিল মত প্রকাশ করেন যে, "অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংল্যান্ডেই আধুনিক অর্থনীতির জন্ম হয়।"
অর্থে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: শিল্পবিপ্লবের ফলাফলকে বিস্তৃত অর্থে বি

(১) অর্থনৈতিক অবস্থা;

(২) সামাজিক অবস্থা;

(৩) রাজনৈতিক অবস্থা।

১। অর্থনৈতিক অবস্থা

শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক ফলাফল লক্ষ করা যায়। উল্লেখযোগ্য ফলাফল নিম্নরূপ: শিল্পবিপ্লবকালে যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হওয়ায় ব্রিটেনের অর্থনীতিতে উৎপাদনক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মাত্র চল্লিশ বছরের ব্যবধানে ব্রিটেনের কয়লা উৎপাদন দশ গুণ বৃদ্ধি পায়। ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পিগ লৌহের উৎপাদন 'ছিল ৬৮,০০০ টন। কিন্তু ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১৩,৪৭,০০০ টনে উন্নীত হয়। ১৭৮১ থেকে ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কাঁচা তুলা আমদানি সাড়ে এগার গুণ বৃদ্ধি পায়, যার মাধ্যমে ব্রিটেনের বস্ত্রশিল্পের উৎপাদনক্ষমতার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। অধ্যাপক ডব্লিউ হফম্যান-এর মতে, "ব্রিটেনের শিল্প উৎপাদন ১৯০ বছরে ৭০ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।"

শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য কৃষির উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বিপ্লবকালে শিল্পখাত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লোকসংখ্যার সংকুলান দিতে আরম্ভ করে। ফলে অধিকতর কৃষি-জনসংখ্যা কাজের জন্য শহরে বা শিল্পাঞ্চলে ভিড় করতে থাকে। ফলে কৃষিতে শ্রমিক সমস্যা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটেনে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে কৃষিতে ৭৭% লোক নিয়োজিত ছিল, সেখানে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে তা ২৮%-এ. নেমে আসে। ফলে মোট জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।

নতুন নতুন আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে সমর্থ হয়। নতুন আবিষ্কারের ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লব ধনাত্মক ভূমিকা পালন করে। হস্তচালিত যন্ত্রপাতির পরিবর্তে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হওয়ায় শিল্পের কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। মানুষের দৈহিক শক্তির পরিবর্তে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার শুরু হয়।

শিল্পবিপ্লবের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ের প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তুলা ও পশমের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের কাঁচামালের জন্য এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য ব্রিটেন বৈদেশিক বাজারের উপর ব্যাপকহারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটেনে খাদ্যাভাব দেখা দিলে খাদ্যের জন্য ব্রিটেনকে প্রচুর কয়লা ও শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানি করতে হয়। এভাবে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বিপুল হারে বৃদ্ধি পায়।

শিল্পবিপ্লবের ফলে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পুঁজিপতি এবং শ্রমিকের মধ্যে নতুন ধরনের বা পরিবর্তিত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পূর্বে পুঁজিপতির পুঁজির পরিমাণ ছিল স্বল্প; শ্রমিকরাও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করত বলে কখনো মালিকের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারত না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান সংগঠিত হওয়ার পর পুঁজিপতি ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক পরোক্ষ ও গৌণ হয়ে পড়ে। শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি চেতনার উন্মেষ ঘটে। বহুসংখ্যক শ্রমিক একত্রে সংগঠিত হয়ে তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করে শ্রমিক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে এবং একে মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করে নেয়। কাজের ন্যায্য মজুরি, শ্রম সময় হ্রাস, চিকিৎসা, পেনশন, ভাতা ইত্যাদি ছিল আন্দোলনের মুখ্য উপাদান। ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যায় এবং সমাজজীবনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যের ব্যবধান বাড়তে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণির সংঘাত ও দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র তৈরি করে, যা ইংল্যান্ডের আর্থসামাজিক অবস্থায় গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে।

২। সামাজিক অবস্থা

শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থায় অনেক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পূর্বে সমাজ সামন্ত ও প্রজা শ্রেণিতে বিভক্ত থাকলেও শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। বুর্জোয়াদের মধ্যে ধনী, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তে স্তর বিন্যাসিত হয়। নিচে প্রধান কয়েকটি পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হলো:

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে বেকার নারী-পুরুষ শহরের দিকে ধাবিত হতে থাকে। সারা শহর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অথচ এসব লোকের সকলের কর্মসংস্থান মেলেনি। জনসংখ্যার আধিক্যহেতু বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা ছাড়া এবং না খেয়ে অনেকে অকালে মৃত্যুবরণ করে। জনসংখ্যার স্থানান্তর তাই প্রথম দিকে শহরাঞ্চলে অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি করে।

শিল্পবিপ্লবের যুগে জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে ব্রিটেনের লোকসংখ্যা এক মিলিয়ন বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী ৫০ বছরে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন এবং ১৮০০ থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ১০ মিলিয়নের বেশি লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মায়ার ও বল্ডউইন-এর মতে, "শিল্পবিপ্লবের সাথে কৃষি ও যাতায়াতব্যবস্থাও উন্নত হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পায় বলে এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে লাভজনকভাবে কাজে খাটানো সম্ভবপর হয়েছিল।"

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শহরে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা কলকারখানায় কাজ নিতে শুরু করে। কারখানায় এ শিশু শ্রমিকরা সারা দিন কাজ করার ফলে তাদের মধ্যে অপুষ্টি এবং বাসগৃহে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে হৃদ্যতার অভার দেখা দেয়। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন লোকেরা যখন শহরের বস্তি এলাকায় বসবাস আরম্ভ করে, তখন যুবক-যুবতী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যে দৈহিক ও অসামাজিক কার্যকলাপ, দুর্নীতি ও কলুষতা অনুপ্রবেশ করে। এভাবে শিল্পবিপ্লব শহরাঞ্চলে বিশেষত শিল্পাঞ্চলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস করার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে হলেও দায়ী। শিল্পবিপ্লবের ফলে বিবাহিত মেয়েরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তাদের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল; প্রথমত, বাসগৃহে বসে জীবিকার জন্য স্বামীর অপেক্ষা করা, অর্থাৎ স্বামীর মজুরির উপর নির্ভরশীলতা। দ্বিতীয়ত, বাড়ি ত্যাগ করে কলকারখানায় পেটের দায়ে কাজ করে খাওয়া। যেহেতু স্বামীর মজুরি পরিবার প্রতিপালনের জন্য যথেষ্ট ছিল না, সেহেতু অনেক বিবাহিত মেয়ে শিল্পে কাজ করতে বাধ্য হতো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় ছিল, একদিকে ঘরের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার সমস্যা এবং অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে 'পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলে আহারের ব্যবস্থা করা। এ অবস্থা পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ডের সামাজিক স্তরবিন্যাসে শিল্পবিপ্লব নতুন মেরুকরণ ঘটায়। পূর্বে কৃষিভিত্তিক সামন্ত সমাজ লর্ড ও প্রজা এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত থাকলেও বিপ্লবের ফলে সমাজ বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। বুর্জোয়াদের মধ্যে আবার ধনী, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ ছিল।

শিল্পবিপ্লব অনেক অকল্যাণ সৃষ্টি করলেও এর দরুন কিছু কিছু কল্যাণেরও জন্ম হয়। কলকারখানায় চাকরির ফলে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে গৃহ-শিল্পের তুলনায় শ্রমিকের উপার্জন বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত হয়। তবে একথা ঠিক যে, পূর্বের তুলনায় শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলেও পুঁজিপতিদের জীবনযাত্রার মানের মতো এটি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়নি।

শ্রমিকদের যাতে অকল্যাণ না হতে পারে তার প্রতি লক্ষ রেখে ব্রিটিশ সরকার আইন পাস করে। ফলে পরবর্তীকালে শিশুশ্রমের অমঙ্গল থেকে দেশ রক্ষা পায়। আবার শ্রমিকদের কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে সরকার তাদের প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করে। এভাবে দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক্সে দরুন ব্রিটেনে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তদুপরি সরকার আইন পাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের বাসস্থানের পরিবেশ সুন্দর এবং শিল্প-কারখানা থেকে আলাদা করে দেয়। এভাবে শিল্পবিপ্লবের শেষ দিকে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার কিছুটা হলেও উন্নয়ন ঘটে।.

৩। রাজনৈতিক অবস্থা

শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনে কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল। পুঁজিপতিদের নেতৃত্ব দখলের সাথে সাথে তাদের অনুকূলে রাজনৈতিক ভারসাম্য অবস্থা চলে আসে। উদ্দেশ্য ছিল, পার্লামেন্টে শ্রমিকের সম্বন্ধে কোনো কথা থাকতে পারবে না। অবশ্য এতে শ্রমিকদের উদ্যোগ পুরোপুরি ব্যাহত হয়নি। তারা একত্রে বসবাস ও কাজ করত বলে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারত। পর্যায়ক্রমে শ্রমিক শ্রেণি সচেতন হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়নের সূত্রপাত হয়। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে সমাজতন্ত্রের ভাবধারা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তারা চার্টিস্ট আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিল্পবিপ্লব ভূস্বামীদের হাত থেকে পুঁজিপতিদের নিকট রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থানান্তরে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নিকট থাকার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে ব্রিটেনে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার দ্যোতক হিসেবে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিকাশ ব্রিটেনে আরম্ভ হয়। এভাবে শিল্পবিপ্লব ব্রিটেনের রাজনৈতিক কাঠামোতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনয়ন করে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ