• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • শিল্প বিপ্লব
শিল্প বিপ্লব

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

শিল্প বিপ্লব

শিল্পবিপ্লবের কারণসমূহ

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে উঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর কৃষি আন্দোলনের ফলে ব্রিটেনে সম্পদের প্রাচুর্য ও পরিমাণের জন্য শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। সম্পদের উদ্বৃত্ত অংশ নিশ্চিত পদক্ষেপ হিসেবে শিল্পবিপ্লবের সূচনা করে। এ ছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে নতুন নতুন আবিষ্কার, বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহৎ ধারণার প্রভাব, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। শিল্পবিপ্লবের কারণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ১. সামাজিক, ২. অর্থনৈতিক ও ৩. রাজনৈতিক।

১। সামাজিক কারণ

জার্মানি, হল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদি সমসাময়িক দেশের তুলনায় তুলনায় ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থা ছিল নমনীয়। সামন্ত ও ভূমিদাসপ্রথা সর্বপ্রথম ব্রিটেন থেকে বিলোপ হয়। আইনের শাসন ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সকল প্রকার সামাজিক কুসংস্কার বিদায় গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বন্ধন ও বাধা-নিষেধমুক্ত স্বাধীন সমাজব্যবস্থা। সামাজিক ক্রমবিকাশের ফলে ইংল্যান্ডে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। শিল্পের সংগঠক ও শিল্পপতিরা এই শ্রেণি থেকে সৃষ্টি হয়। জমিদারদের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের জন্য উদ্যোক্তারা দেশে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
মধ্যযুগে ধর্মীয় কোন্দলের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দক্ষ শ্রমিক দেশ ত্যাগ করে ব্রিটেনে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। তারা বিভিন্ন শিল্পে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করে। যন্ত্রপাতির কারখানা আবিষ্কার হওয়ার পর নতুন পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত হয়। ফলে তাদের দ্বারা উৎপাদনে আধুনিক ও'কারিগরি উন্নয়ন দ্রুত সম্ভব হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ব্রিটেনে লোকসংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লোকের জন্য অধিক খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির প্রয়োজন হয়েছিল। এসব উদ্দেশ্য পূরণ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয়।

২।। অর্থনৈতিক কারণ

ষোড়শ শতাব্দীর বেষ্টনীকরণ (Enclosure) আন্দোলন অষ্টাদশ শতাব্দীতে অধিকতর জোরদার হয়ে ওষ্ঠে। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাড়তি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করাই ছিল এ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ। এ আন্দোলনই ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর প্রচলিত কৃষিব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে আধুনিক উন্নত চাষাবাদের উন্মোচন করে, যা শিল্পবিপ্লবের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

তৎকালীন সময়ে ব্রিটেন ছিল বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী দেশ। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে ব্রিটেনে উৎপাদিত দ্রব্যাদির চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিক্রেতারা বাইরে দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে চাহিদার সাথে সংগতি রেখে আরও বেশি উৎপাদন করার স্পৃহা উৎপাদকদের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। ক্রমবর্ধিত চাহিদা সৃষ্টি এবং তার পূরণ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করে।

ব্রিটেনে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি দ্রুত সম্ভব হয়েছিল। কয়লা, লৌহ প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার পদক্ষেপ হিসেবে কয়লা ইঞ্জিন ও বাষ্পীয় ইঞ্জিন শিল্পোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পেরেছে। তাছাড়া উৎসাহী পুঁজিবাদীরা তাদের পুঁজি ও নতুন কলাকৌশল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিতে নিয়োজিত করেন, যা কৃষিবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। এ বিপ্লব শিল্পবিপ্লবকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটেনে অনেক নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার শুরু হয়। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি প্রথমে বস্ত্রশিল্পে প্রয়োগ করা হয়। এতে ধনাত্মক উন্নয়নের পদক্ষেপ সৃষ্টি হলে ধাপে ধাপে অন্যান্য শিল্পেও এটি প্রয়োগ করা হয়। এভাবে নতুন নতুন আবিষ্কার ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করে।

ব্রিটেনের অধিক সম্পদ শিল্পবিপ্লবকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। বিদেশ থেকে বাণিজ্যের মাধ্যমে যখন প্রচুর অর্থ ব্রিটেনে সংগৃহীত হতে থাকে তখন উৎপাদনব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারণ করে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। অধিক লাভ এবং মুনাফা শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করে তোলে।

উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের একমাত্র বাহক হচ্ছে যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থা। ব্রিটেনের উন্নত পরিবহন বা যাতায়াতব্যবস্থা পণ্য চলাচলের জন্য খুবই সুবিধাজনক ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে ব্রিটেনের পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কৃষিপণ্যকে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য পরিবহনের অবদান তাই উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটেনের উন্নয়নে প্রাথমিক অবস্থায় অধিক পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল। এ সকল সম্পদকে (যেমন- লৌহ, কয়লা) সঠিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী করার বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ পদক্ষেপের ফলে কয়লা ইঞ্জিন, বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও লৌহজাত দ্রব্য আবিষ্কার হয়, যা শিল্পবিপ্লবের পথ সুগম করে।

শিল্পবিপ্লবের বহু পূর্বেই ব্রিটেন আমেরিকা ও এশিয়ায় অনেক উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ঐ উপনিবেশগুলো ব্রিটেনের বহির্বাজার হিসেবে কাজ করত। শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্য উপনিবেশের বাজারে বাজারজাতকরণ সহজ ও লাভজনক ছিল। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শিল্পবিপ্লবকে উৎসাহিত করে তোলে। ব্রিটেনের শিল্পজাত দ্রব্যের মান উন্নত বলে বিশ্ব বাজারে এর চাহিদা ছিল ব্যাপক। ফলে তা অধিক উৎপাদন, অধিকতর 'কারিগরি উন্নয়ন ও আবিষ্কারে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

শিল্পবিপ্লব সৃষ্টিতে কৃষিবিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। শিল্প সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান শহর ও শিল্পে অধিক শ্রমিকের খাদ্য জোগান কৃষিবিপ্লবের অবদান। শিল্প উৎপাদনের প্রাথমিক উপাদান অর্থাৎ কাঁচামাল, যা কৃষি থেকে আসে। এভাবে কৃষিবিপ্লব শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।

৩। রাজনৈতিক কারণ

শিল্পবিপ্লব সৃষ্টিতে রাজনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুকূল ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা শিল্পক্ষেত্রে অধিক বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য মহৎ ধারণাকে দায়ী করা হয়। সারা ইউরোপে গণজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের ফলে জনগণের মনমানসিকতা থেকে কুসংস্কার দূরীভূত হয় এবং মানুষ উদার ও প্রগতিশীল হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে মানুষের মধ্যে পুরনো ধ্যানধারণার স্থলে বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। ফলে সামাজিক জগতে পরিবর্তন আসে, যা শিল্পবিপ্লবের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

বিপ্লবপূর্ব ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা সুসংহত ও স্থিতিশীল ছিল না। ১৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দের পর ব্রিটেনে একটি সুসংহত, স্থিতিশীল ও গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। বিশেষ করে ওয়ালপোল-এর সংস্কার ও নীতিমালা ব্রিটেনের জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক মৌলিক পরিবর্তন এনে দেয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে যুক্ত হয়ে শিল্প উন্নয়নকে দ্রুত অগ্রসর করতে সহায়তা করে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ ব্রিটেনে স্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম দেয়। এতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মুনাফাকে কেন্দ্র করে যে ব্যক্তি উদ্যম শিল্পায়নে প্রবেশ করে, তা ব্রিটেনের শিল্পক্ষেত্রে নতুন নতুন শিল্প উদ্যোক্তার জন্ম দেয়। এভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ শিল্পবিপ্লবকে পরোক্ষভাবে ত্বরান্বিত করে।
ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন কারণের মধ্যে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা বলা কঠিন। দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে আমরা ক্রমানুসারে বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, নতুন নতুন আবিষ্কার ও মহৎ ধারণার প্রভাবকে চিহ্নিত করতে পারি।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ