- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি || Islamic Education and Culture
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি || Islamic Education and Culture
বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশিষ্ট আলেম-উলামা, পির-মাশায়েখ ও অলি-দরবেশগণের অবদান
মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র। যুগে যুগে এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক বিখ্যাত আলেম-উলামা, পির-মাশায়েখ, অলি-দরবেশ। এছাড়া ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আগমন করেছেন বহু পির, অলি, দরবেশ, সুফি-সাধক। তাদের পদচারণায় এদেশ ধন্য হয়েছে। তারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাওহিদ, রিসালাত, ইবাদত, সিরাত, আখলাক ও নৈতিকতার মর্মবাণী। এদেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নেও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের সূচনা।
বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে। আরবের মুসলিম বণিক দলের মাধ্যমে এদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। কয়েকজন আলেম-উলামা ও মুজাহিদ শুধু ইসলাম প্রচারের জন্যই এদেশে আগমন করেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এখানে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। এখানেই তাদের মৃত্যু হয়। এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু আলেম, দরবেশ আসেন। তখনকার প্রতিষ্ঠিত হিন্দু রাজাগণ এসব অলি-দরবেশ ও পির মাশায়েখদের প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেন এবং তাদের কাজে বাধা দেন। তারপরও মুজাহিদগণ থেমে থাকেননি। তাদের চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলায় ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে যেসব মনীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাদের সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রহ) (১৮৭৫-১৯৫০ খ্রি.)
মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী হলেন বাংলাদেশের আজাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, শ্রেষ্ঠ আলেম, গ্রন্থকার, বাগ্মী, সমাজসেবক ও বিশিষ্ট ভাষাবিদ। তিনি ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফ এ পাস করেন। অতঃপর ১০ বছর যাবৎ আরবি, উর্দু, ফারসি ও বাংলা অধ্যয়ন করে উক্ত ভাষাসমূহে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি হুগলির একটি মাদরাসায় চাকরি নেন। তার জীবদ্দশায় তিনি আঞ্জুমানে ওলামা সম্মেলন, সাহিত্য সম্মেলন, শিক্ষা সম্মেলন, যুব সম্মেলনসহ ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন।
হযরত শাহজালাল (রহ) (১২৪৬-১৩৪৬ খ্রি.)
হযরত শাহজালাল (রহ) ১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ামেনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুহাম্মদ। হযরত শাহজালাল (রহ) শৈশবে মাতা-পিতা উভয়কে হারান। এরপর তিনি তার এক আত্মীয়ের কাছে লালিত-পালিত হন। অল্প বয়সেই তিনি কুরআন, হাদিস, আকাইদ, উসুল, ফিকহসহ ইসলামি জ্ঞানের সব শাখায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এরপর আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন এবং উচ্চ স্থান লাভ করেন। হযরত শাহজালাল (রহ) ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন। ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লি থেকে সিলেট এসে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার সম্পর্কে সমকালীন পর্যটক ইবনে বতুতা লিখেছেন, এদেশের অধিকাংশ লোক তার হাতেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। বিশেষত সিলেট, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, আসাম ও নোয়াখালীর লোক তার হাতে ইসলামের দীক্ষালাভ করেছেন। হযরত শাহজালাল (রহ) এর ইসলাম প্রচার এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি বিস্তারের বিবরণ সম্পর্কে 'গুলজার-ই আবরার' ও 'সুহাইল- ই-ইয়ামান' গ্রন্থে একমত পোষণ করা হয়েছে। তিনি কুফর, শিরক ও বিদআতের বিপক্ষে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। হযরত শাহজালাল (রহ) ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তার মাজার সিলেটে অবস্থিত।
শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ) (মৃত্যু: ১৩০০ খ্রি.)
শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বুখারার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। শৈশবে বিদ্যার্জনের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। গ্রন্থপাঠ করে নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করায় তিনি উৎসাহবোধ করতেন। ইমাম বুখারি (রহ)-এর ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি বুখারি শরিফসহ হাদিসের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর পারস্যের খোরাসানে গিয়ে ইসলামি জ্ঞানের সব শাখায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এরপর কিছুদিন তিনি ঐ অঞ্চলে ইসলামি বিষয়াবলি শিক্ষাদান করেন। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে তিনি দিল্লি এসে একটি মসজিদ, একটি মাদরাসা, একটি খানকাহ (ইসলাম প্রচারকেন্দ্র) স্থাপন করেন এবং ইসলামি জ্ঞান বিতরণে আত্মনিয়োগ করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় কুরআন, হাদিস, ফিকহ, ইলমুত তাওহিদ, ইলমুল আদব, ইতিহাস, সীরাত, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, ব্যবসায় শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হতো। শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ) নিজে জ্যোতিষশাস্ত্র, রসায়ন ও দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন। তার কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে যারা বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মুনাযরী, শায়খ বদরুদ্দীন যায়েদ, শায়খ যঈন ইরাকি ও শায়খ ইবরাহিম দানেশমন্দ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ) ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
হযরত খানজাহান আলী (রহ) (১৩৭৯-১৪৫৯ খ্রি.)
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ইসলাম প্রচার, ইসলামি ভাবধারার প্রচলন, ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামি শিক্ষা- সংস্কৃতির বিকাশে যার নাম প্রথমেই আসে তিনি হলেন হযরত খানজাহান আলী (রহ)। তার আসল নাম উলুগ খানুল আযম খান-ই জাহান। তিনি ১৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দিল্লিতে ব্যবসায় করতেন। পিতার ব্যবসায়ী সফরে তিনি পিতার সঙ্গে দিল্লি আগমন করেন। পিতা তাকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে নূর কতুবুল আলমের মাদরাসায় ভর্তি করান। খানজাহান আলী (রহ) ঐ মাদরাসা থেকে আরবি ভাষা, কুরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করে ইসলাম প্রচার, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করেন। সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ-এর শাসনামলে হযরত খানজাহান আলী (রহ) ইসলাম প্রচার করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। বাগেরহাট, যশোর ও খুলনার অধিকাংশ হিন্দু ব্রাহ্মণ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এসব এলাকায় তিনি অনেক মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণ করেন এবং দিঘি (বড় পুকুর) খনন করেন। এর মধ্যে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ অন্যতম । ঐ মসজিদটিতে মূলত ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। এছাড়া তিনি ও তার শিষ্যরা বারবাজার, মুড়লী, খানপুর, বিদ্যানন্দকাটি ও আমাদি অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজ করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। খানজাহান আলী (রহ) ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। তাকে বাগেরহাটে সমাহিত করা হয়।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ) (৮০৪-৮৭৪ খ্রি.)
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এক অনবদ্য নাম বায়েজিদ বোস্তামী। তিনি চট্টগ্রাম ও আশেপাশের জেলাগুলোতে ইসলাম প্রচারের কাজে নিবেদিত ছিলেন। তার ওস্তাদ ছিলেন সিন্ধুর অধিবাসী আবু আলী । ওস্তাদ আবু আলীর নির্দেশেই তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে আগমন করেন। নাসিরাবাদের পর্বত চূড়ায় তার স্মৃতি বিদ্যমান। তার ভক্তবৃন্দ চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ইসলামের প্রচার করেন ।
মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ) (১৮০০-১৮৭৩ খ্রি.)
মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ) সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রহ) এর শিষ্য ছিলেন। তিনি কলকাতায় কিছু দিন অবস্থান করেন। তারপর ইসলামের মর্মবাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ও আসামের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় তার দখল ছিল অসাধারণ। তিনি 'মিফতাহুল জান্নাত' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় চল্লিশ খানা বই রচনা করেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ) বিধর্মীকে ইসলামে দাখিলের চেয়ে নামধারী মুসলমান যারা কুরআন ও হাদিসের আদর্শ থেকে দূরে চলে গেছে তাদেরকে ইসলামের প্রকৃত আদর্শে ফিরিয়ে আনাকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি বরিশাল, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও রংপুর এলাকাসমূহে ইসলামের সংস্কারের কাজ করেন। তিনি মূলত শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেন। মানুষের মধ্যে তাঁর বক্তব্য যাদুর মতো কাজ করতো। তাঁকে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতো। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ) শেষ জীবনে রংপুরে অবস্থান করেন। তিনি ১৮৭৩ সালের ৩০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রংপুর শহরের মুনশিপাড়ায় তাকে সমাহিত করা হয়।
হযরত শাহ মাখদুম রুপোশ (রহ) (১৪৭৫-১৫৬২-খ্রি.)
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের জন্য হযরত শাহ মাখদুম স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১৪৭৫ খ্রি. (৬১৪ হিজরি) ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশে আসেন। শাহ মাখদুম (র) প্রথমে নোয়াখালীতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী চলে আসেন। রাজশাহী অঞ্চলের মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। সারারাত ইবাদত বন্দেগিতে কাটাতেন এবং দিনের বেলায় মানুষকে হেদায়েতের পথে ডাকতেন। তাকেও বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। জনশ্রুতি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, তিনি বাঘার কাছে একটি ছোট কিল্লা তৈরি করে সেখানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মুজাহিদ গড়ে তুলতেন। সে সময়ে রামপুর রাজ্যের মহাকাল মন্দিরে নরবলির মাধ্যমে মহাকাল দেবের পূজা হতো। এ কথা শুনে শাহ মাখদুম রামপুরের মাহাকালগড় আক্রমণ করেন ও রাজাকে পরাজিত করে তা দখল করেন। এ যুদ্ধে শাহ মাখদুমের অনেক সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতে অবস্থান করেন। শাহ মাখদুম (র) ১৫৬২ খ্রি.(৭৩১ হিজরি) ইন্তেকাল করেন। রাজশাহী শহরে পদ্মা নদীর তীরে দরগাপাড়া মহল্লায় তার সমাধিটি আজও মানুষকে ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
হযরত শাহ আমানত (রহ) (১৬৮০-১৮০৬ খ্রি.)
হযরত শাহ আমানত (রহ) চট্টগ্রামের বিখ্যাত অলি ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের নিবাস ছিল ইরাকে। তাঁর পূর্বপুরুষগণ বংশ পরম্পরায় বুজুর্গ ছিলেন। শাহ আমানত (রহ) এর পিতার নাম হযরত নিয়ামত শাহ (রহ)। তিনি ছিলেন বড় পির হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ)-এর বংশধর । মহান সূফি সাধক শাহ আমানত (রহ) ইসলাম ধর্ম প্রচার ও আল্লাহর সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। শাহ আমানত (রহ) প্রথমে বিহারে বসবাস করতেন। সংসারের সমস্ত মায়া-মমতা ত্যাগ করে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য বিহার থেকে কাশ্মীর চলে যান। সেখানে প্রখ্যাত সাধক পির হযরত শহীদ (র) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি সেই পিরের কাছে অবস্থান করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন করেন এবং কঠোর সাধনা করে আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষে পৌছাতে পেরেছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন। তাঁর চট্টগ্রাম আগমনের সঠিক সময় জানা না গেলেও ধারণা করা হয় ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের পরে তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি সবসময় ইহরামের কাপড়ের মত সাদা কাপড় পরিধান করতেন। শাহ আমানত (রহ) উঁচু স্তরের অলি হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম জজকোর্টের একটি ছোট পদে (পাখা টানার কাজ) সরকারি চাকরি করতেন। শাহ আমানত (রহ) অধিকাংশ সময় ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকতেন। অল্প আহার ও অধিক ইবাদত ছিল তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অন্যতম। সারাদিন চাকরি করে রাতের বেলায় বা অবসর সময়ে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশায় তিনি এগিয়ে আসতেন এবং সেবাযত্ন করতেন। ফলে সাধারণ মানুষ তার খুব আপন হয়ে যেতো। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন খান সাহেব' নামে। চট্টগ্রামে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তার অবদান অপরিসীম। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষকে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ইসলামি অনুশাসনের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভক্তদের তিনি হালাল উপার্জন, সৎ জীবনযাপন, সংযমী ও ইবাদতে মশগুল থাকার পরামর্শ দিতেন। ইন্তিকালের পর তাঁকে চট্টগ্রামের লাল দিঘির পূর্ব দিকে দাফন করা হয়। সেখানেই বর্তমানে তাঁর খানকাহ শরিফ অবস্থিত।
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) (১৮৯৫-১৯৬৮ খ্রি.)
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সুফি সাধক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গওহরডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ প্রায় তিনশত বছর আগে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আসেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় এ্যাঙ্গলো-পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাঁচটি লেটারসহ উত্তীর্ণ হন এবং সারাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। অতঃপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। এ সময় মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ভাবলেন, কেবল পার্থিব জগতের জ্ঞান অর্জন করা জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আখিরাতের জীবনই আসল জীবন। তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল দুনিয়া ও আখিরাতের সমন্বিত শিক্ষা অর্জনের জন্য। কলেজ ছেড়ে তিনি ভর্তি হন উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ দীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ' মাদরাসায়। অল্প দিনের মধ্যে শিক্ষকদের মাঝে তার মেধার প্রখরতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। ঐ মাদরাসা থেকে তিনি কুরআন, হাদিস, তাফসির, উসুল, আইনশাস্ত্র ও অলংকারশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনসহ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে দুই বছর তার সান্নিধ্যে অতিবাহিত করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর শুরু হলো তার ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারের কার্যক্রম। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) 'ছদর ছাহেব' নামে পরিচিত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি হাদিসের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা এবং ঢাকার আশরাফুল উলুম বড় কাটরায় শিক্ষকতা করেছেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) 'লালবাগ জামিআ কুরআনিয়া আরাবিয়া' মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাগেরহাটের গজালিয়া মাদরাসা, আশরাফুল উলুম বড় কাটরা মাদরাসা, তার নিজ গ্রামে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম গওহরডাঙ্গা মাদরাসা, ঢাকার ফরিদাবাদের জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুমসহ বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) একজন বিখ্যাত লেখকও ছিলেন। তার রচিত ৬৫টি গ্রন্থ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— হাক্কানী তাফসীর, জীবনের পরিচয়, চরিত্র গঠন, বেহেশতী জেওর, তাবলীগে দীন ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন।
ছারছীনার পির মাওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ (রহ) (১৮৭২-১৯৫২ খ্রি.)
মাওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ (রহ) পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ থানার ছারছীনা (তৎকালীন নাম শর্ষিনা) গ্রামে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে মাদারীপুরের একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে ভর্তি হন ঢাকার হাম্মাদিয়া মাদরাসায়। ঐ মাদরাসায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। ঐ মাদরাসায় অধ্যয়ন শেষে ভর্তি হন হুগলি মাদরাসায়। হুগলি মাদরাসা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ফুরফুরার পির মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকি (রহ) এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তার কাছ থেকে খিলাফত লাভ করেন। এরপর তিনি শুরু করেন সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কাজ। পিরের পরামর্শ অনুযায়ী নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন 'ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদরাসা', কুতুবখানা, হাফেজিয়া মাদরাসা, লাইব্রেরিসহ বহু প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সর্বত্র রয়েছে তার অসংখ্য মুরিদ। ছাত্র এবং মুরিদদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে তিনি 'জমঈয়তে হিযবুল্লাহ' এবং 'ছাত্র হিযবুল্লাহ' নামে অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এ সংগঠনের শাখা রয়েছে। ১৯৫২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা হাজি শরীয়তুল্লাহ (রহ) (১৭৮১-১৮৪৩ খ্রি.)
মাওলানা হাজি শরীয়তুল্লাহ (রহ) ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর অঞ্চলের শামাইল গ্রামে ১৭৮১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার মাওলানা বাশারাত আলীর তত্ত্বাবধানে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর মক্কা শরিফ গমন করে সেখানে ২০ বছর অবস্থান করে উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা অর্জন করেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ মক্কায় অবস্থানকালীন মাওলানা তাহের চোম্বলের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। অতঃপর মিশর, ইরাকসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে ১৮২৪ সালে দেশে ফিরে এসে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ইসলামকে কুসংস্কারমুক্ত করে মুসলমানদের সংস্কারের জন্য তিনি ফরায়েজি আন্দোলন' শুরু করেন। তার এ আন্দোলনের পথ ধরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকে। তারই সফলতার ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। সালে মাওলানা হাজি শরীয়তুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
চরমোনাইর পির মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক (রহ) (১৯০৮-১৯৭৪ খ্রি.)
মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক (রহ) বরিশাল শহরের কাছে কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী পশুরিকাঠি গ্রামের বিখ্যাত সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভোলার একটি মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতের 'দারুল উলুম দেওবন্দ' যান এবং সেখান থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করে দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহির বিশিষ্ট খলিফা উজানির পির ক্বারী ইবরাহিম (রহ) এর কাছে চিশতিয়া ছাবেরিয়া তরিকা অনুশীলন করেন । মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বরিশালের চরমোনাইতে 'আহছানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদরাসা' প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত ঐ মাদরাসায় পাঠদান অব্যাহত রাখেন। তিনি বাংলাদেশের খ্যাতনামা পিরদের মধ্যে অন্যতম। সারাদেশে তার অসংখ্য মুরিদ রয়েছে। নিজ বাড়িতে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ ও ফাল্গুন মাসে বিশাল মাহফিলে লক্ষাধিক মানুষকে তিনি ইসলামের দীক্ষা দিতেন। এছাড়া সারা দেশে সফর করে তিনি ওয়াজ ও মাহফিলের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা বিকাশে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। বায়তুশ শরফের পির মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ) (১৯৩৩-১৯৯৮ খ্রি.) সমাজসেবক পির হিসেবে খ্যাত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ) ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়া উপজেলার বড়হাতিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গারাঙ্গিয়া মাদরাসা থেকে ফাযিল এবং চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তার পির মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতারের নির্দেশে দরবারে চলে আসেন। পিরের ইন্তেকালের পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত তরিকতের কাজ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রাম শহরে 'বায়তুশ শরফ' নামে তার খানকাহ রয়েছে। আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি তিনি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা। ইসলাম ও মানবতার সেবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ'। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন।
একক কাজ: বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখা পির-মাশায়েখ ও অলি- দরবেশগণের একটি তালিকা তৈরি করো।