- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
পৌরনীতি ও সুশাসন পরিচিতি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পৌরনীতি ও সুশাসন পরিচিতি
পৌরনীতি পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা | Necessity and Importance of the Study of Civics
মানবজীবনকে সমৃদ্ধ করতে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতিকল্পে জ্ঞানের সকল শাখায় অবাধ বিচরণ একান্তই আবশ্যক। পৌরনীতি নাগরিক জীবন সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে বিধায় সভ্য সমাজের প্রত্যেক সদস্যের পৌরনীতির পাঠ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। নিচে এ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো:
১. রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ পৌরনীতি এমন একটি শাস্ত্র, যা রাষ্ট্র ও সরকারের নানাবিধ দিক নিয়ে আলোচনায় মুখর। এটা একদিকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের গঠন কাঠামো ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। অপরদিকে সরকার, এর শ্রেণিবিভাগ, সরকারের বিভিন্ন রূপ, বৈশিষ্ট্য, দোষ, গুণ, বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থার সাফল্যের অপরিহার্য শর্তাবলি, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, সংবিধান, এর প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য, সংবিধান প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান করে, যা রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে অর্জন করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে এরিস্টটলের এই বিখ্যাত উক্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়- "মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।"
২. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ পৌরনীতি পাঠে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Political Institutions) ও সংস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের গঠনপ্রণালি, ক্ষমতা ও কার্যাবলি, রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা, নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচকমণ্ডলী, জনমত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে
বিশদ জ্ঞান লাভ করা যায়।
৩. রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যও পৌরনীতি পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৌরনীতি নাগরিকের উন্নততর জীবনের দিকনির্দেশনা দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক Aristotle (Father of Political Science) বলেন, "মানুষের সুন্দর জীবনযাপনের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং উন্নততর জীবনের জন্য রাষ্ট্র সক্রিয় থাকবে।"
৪. অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা: যদিও দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া থাকে তথাপিও পৌরনীতি পাঠ ব্যতীত উক্ত অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায় না। পৌরনীতি নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করে। অধিকার কী, কত প্রকার, নাগরিকগণ কী কী অধিকার উপভোগের দাবিদার, কর্তব্য কী, নাগরিকদের কী কী কর্তব্য রয়েছে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন? আবশ্যক। কেননা, নাগরিকগণ প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও শিক্ষা লাভ করেই সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
৫. সুনাগরিকতার শ্রেষ্ঠ পাঠ: বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই গণতন্ত্রের জয়-জয়কার অবস্থা। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্য সর্বতোভাবে নির্ভর করে সুনাগরিকের ওপর। তবে সুনাগরিকতার তিনটি অপরিহার্য গুণাবলি যেমন- আত্মসংযম (Self Control), বৃদ্ধি (Intelligence) ও বিবেকবোধ (Conscience)-এর পরিপূর্ণ সমন্বয় ঘটলে নাগরিকগণ দেশ ও জাতি সম্পর্কে অধিক সচেতনতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাই পৌরনীতি সুনাগরিকতার পাঠ প্রদান করে।
৬. রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভ রাজনৈতিক উন্নয়নের (Political Development) ধারণা থেকেই উন্নত-অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। আর এই রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে পৌরনীতি। উন্নয়নের বিভিন্ন ধারা ও পদ্ধতি-কৌশল সম্পর্কে পৌরনীতি সবিস্তারে আলোচনা করে। আর রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হলে উন্নয়নের ধারা ও পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ অপরিহার্য।
৭. আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্পর্কে ধারণা আন্তর্জাতিক রাজনীতির (International politics) দৃষ্টিতে বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। বিশ্ব আজ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও সামরিক ব্লকে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ শক্তি ও সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সদা তৎপর। পাশাপাশি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি প্রতিরোধে গড়ে উঠেছে বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘ (UNO)। পৌরনীতির পরিধি বা আলোচনার ক্ষেত্র নিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে বিধায় পৌরনীতি এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্পর্কেও ধারণা প্রদান করছে। আর তাই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একজন নাগরিককে এসব সংস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বার্নার্ড শ-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষাই সভ্যতার একমাত্র রক্ষাকবচ।"
৮. কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা বর্তমানে কোনো রাষ্ট্রই পুলিশি রাষ্ট্র (Police State) নয়। সব রাষ্ট্রই কম-বেশি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State)। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা লাভ করা যায় পৌরনীতি থেকে। যে রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি পূরণ করে উন্নত সমাজজীবন নিশ্চিত করতে পারে-সেটাই কল্যাণ রাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। যেমন- সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড। আর এসব কর্মকাণ্ডের সফলতা নির্ভর করে সচেতন নাগরিক জীবনের উপর।
৯. সুশাসন সম্পর্কে ধারণা সুশাসন কী এবং কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়- এ সম্পর্কে পৌরনীতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করে থাকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা, ক্ষমতার সুষম বণ্টন, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রভৃতি বিষয় সুশাসনের শর্ত হিসেবে কাজ করে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন, স্থানীয় শাসন জোরদারকরণ, কার্যকরী আইনসভা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় সুশাসনের জন্য অপরিহার্য।
১০. নাগরিকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: বলা হয়, পৌরনীতি নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। অতীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাগরিক জীবনের ধরন কেমন ছিল, বর্তমানে কী রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং অতীত ও বর্তমানের আলোকে নাগরিকের ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও পৌরনীতি সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন নাগরিকের ভূমিকা ও অবস্থান কী হবে সে সম্পর্কেও জানা যায় পৌরনীতি পাঠের মাধ্যমে।
১১. দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের সুদূরপ্রসারী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকার ওপর। তাই দেশপ্রেমিক একটি দেশের অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। পৌরনীতির জ্ঞান নাগরিকদের দেশপ্রেম জাগ্রত করার মাধ্যমে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক তার দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে।
১২. যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার শিক্ষা: পৌরনীতি পাঠের মাধ্যমে আজকের তরুণরা সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে জানতে পারে। পৌরনীতি সুনাগরিক সৃষ্টি ও যোগ্য নেতৃত্বের শিক্ষা দেয়। তাই ভবিষ্যতের যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য পৌরনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
১৩. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ পৌরনীতি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ গঠন করে পৌরনীতি আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজ অধিকার ভোগ ও মতামত প্রকাশের পাশাপাশি অন্যের মতামত প্রকাশের সুযোগ প্রদানের মানসিকতা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, যা একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
১৪. সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনের শিক্ষা পৌরনীতি আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সদস্য একজন নাগরিককে সুশৃঙ্খল, সুন্দর জীবন ও সমাজ গঠনের দিক নির্দেশনা প্রদান করে। তাই সুস্থ ও সুন্দর নাগরিক জীবন গড়ে তোলা এবং সমৃদ্ধ আগামীর জন্য পৌরনীতি পাঠ করা সকলের জন্য খুবই প্রয়োজন।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিক জীবনের পরিসর যত ব্যাপকতর পৌরনীতির আলোচনা ক্ষেত্রও তত প্রসারিত। তাছাড়া বর্তমানে নাগরিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নব নব সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, যার সমাধান পৌরনীতির মূলে নিহিত। এ কারণে পৌরনীতির জ্ঞান ব্যতীত নাগরিক জীবন (Civil life) পরিপূর্ণতা পায় না। অন্যদিকে আইন, স্বাধীনতা, সাম্য, নৈতিকতা, সমাজ, পরিবার, গোষ্ঠী, সংঘ, সম্প্রদায়, ব্যক্তি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে পৌরনীতির বিকল্প নেই। তাই পৌরনীতি পাঠ একান্তই অপরিহার্য যা দেশ ও জাতির কল্যাণকে ত্বরান্বিত করবে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ