- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
পৌরনীতি ও সুশাসন পরিচিতি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পৌরনীতি ও সুশাসন পরিচিতি
পৌরনীতি ও সুশাসনের ক্রমবিকাশ | Evolution of Civics and Good Governance
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৬০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে ইউরোপীয় রাজনীতির তত্ত্ব আলোচনার সূত্রপাত হয়। পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Civics ল্যাটিন (Latin) শব্দ Civis এবং Civitas শব্দ থেকে এসেছে। এদের অর্থ যথাক্রমে নাগরিক ও নগররাষ্ট্র। প্রাচীন গ্রিসে এক একটি নগর ছিল এক একটি রাষ্ট্র। এদের মধ্যে এথেন্স ও স্পার্টা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ নগররাষ্ট্রগুলোর আয়তন ছিল বর্তমান সময়ের একটি জেলা শহরের ন্যায় এবং লোকসংখ্যাও ছিল খুবই কম। নগররাষ্ট্রের মধ্যে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করত অর্থাৎ সামরিক ও বেসামরিক কাজে সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করত তারাই কেবল নাগরিক অধিকার ভোগ করত। কিন্তু বর্তমানে নগররাষ্ট্র বিরল।
বর্তমানে পৌরনীতিকে শুধু শব্দগত অর্থে আলোচনা করা হয় না। কেননা, বর্তমান রাষ্ট্রগুলো প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্র নয়, বরং এগুলো এখন 'জাতি-রাষ্ট্র' হিসেবেই সমধিক পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো অপেক্ষা বর্তমানের জাতি-রাষ্ট্রগুলো আয়তনে যেমন বড়, জনসংখ্যাও তেমনি বেশি। এসব জাতি-রাষ্ট্রে নাগরিক জীবন এবং কার্যাবলি জটিল ও বহুমুখী (Complex and Multipurpose)। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভূমিকা ও কার্যাবলি, আচার-আচরণ এবং তাদের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক (Socio-economic), রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে যে শাস্ত্র আদর্শ নাগরিক জীবনের ইঙ্গিত দান করে, তাই হলো পৌরনীতি।
পৌরনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আর সামাজিক বিজ্ঞান হলো গতিশীল (Dynamic) বিজ্ঞান। সুতরাং গতিশীল বিজ্ঞান হিসেবে পৌরনীতিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, যা এর পরিধিকে সম্প্রসারিত করছে।
সুশাসন বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। সুশাসন প্রত্যয়টির ব্যবহার ও আলোচনা সাম্প্রতিককালে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সুশাসনের ধারণা নতুন না হলেও-এর আলোচনা বা বিষয়টির অবতারণা হয়েছে ধীরে ধীরে, হঠাৎ করে নয়।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তার সরকারের শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়ে এবং রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনায় সুশাসন প্রত্যয়টির ব্যবহার করেন। এরিস্টটল সরকারের শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়ে জনগণের কল্যাণে পরিচালিত সরকারকে 'স্বাভাবিক সরকার' এবং জনস্বার্থ বিরোধী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত সরকারকে 'বিকৃত সরকার' বলে অভিহিত করেন। তার মতে রাষ্ট্রের প্রধান ও পবিত্রতম লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকদের উন্নত ও কল্যাণকর জীবন নিশ্চিত করা। শুধু তাই নয়, এরিস্টটল জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় জীবনে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিপ্লবের কারণ অনুসন্ধান করেন এবং তা নির্মাণের উপায় সম্পর্কেও আলোচনা করেন।
এরিস্টটল সেই প্রাচীনকালেই রাষ্ট্রে নিয়মতন্ত্রবাদ ও আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। আর এসবের লক্ষ্য ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে জনগণের সর্বোত্তম নাগরিক জীবন নিশ্চিত করা; যাকে আধুনিক পরিভাষায় 'সুশাসন' বলা হয়। আধুনিক যুগের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবক্স, জন লক ও জ্যাঁ জ্যাক রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদের আলোচনার মধ্যে সেই কথারই প্রতিধ্বনি লক্ষ করা যায়। জন লক তার বিখ্যাত "সোস্যাল কন্ট্রাক্ট" গ্রন্থে জনগণের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাকে জনগণের বৈধ অধিকার বলে উল্লেখ করেন। জন লকের এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সরকার নির্বাচিত হওয়া, দায়িত্বশীলতার সাথে সরকার পরিচালনা করা অর্থাৎ সুশাসন ভিত্তিক সরকারের ধারণাটি তত্ত্বগতভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের উন্নত ও কল্যাণকর জীবনের শর্তসমূহের বিস্তৃতি লাভ করে। সেই সাথে সুশাসনের ধারণাও ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার দায়িত্বশীল প্রশাসন দ্বারা স্বচ্ছতার সাথে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করবে, জনগণ তা প্রত্যাশা করে। আর প্রত্যাশার প্রতিফলন হলো প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা। আর এসব বিষয়ের সমষ্টিগত রূপ হলো সুশাসন। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে আফ্রিকা অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ১৯৯১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় শুধু নীতি প্রণয়ন, সংস্কার দিয়ে উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশসমূহে উন্নয়নের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সুশাসন। বিশ্বব্যাংক সাহায্য, অনুদানের শর্ত হিসেবে তখন থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিতে থাকে। অর্থাৎ সাহায্য অনুদান হিসেবে প্রদেয় অর্থ, যথাযথভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে উন্নয়ন কাজে ব্যয় করতে হবে। এভাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংক ৬টি সূচক নির্দেশ করে। যথা:
১. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি
৩. সরকারের কার্যকারিতা
৪. নিয়ন্ত্রণের মান (Regulatory quality)
৫. আইনের শাসন (Rule of Law)
৬. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ (Control of Corruption) |
এসব সূচক পরিমাণের মাধ্যমে সুশাসনের বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়। এভাবেই সুশাসনের ধারণাটি বিকাশ ও প্রসার লাভ করে। বিগত শতকের শেষের দিক থেকে ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে দাতা দেশ এবং সংস্থাগুলো (Doner Countries and Institutions) ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর ঋণ গ্রহণের শর্ত হিসেবে সুশাসনের উপর গুরুত্বারোপ করে। সম্প্রতি দাতারা তথা বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের ঋণ গ্রহণের 'পূর্বশর্ত (Pre-requisite) হিসেবে সুশাসনের উপর অত্যধিক জোর দিচ্ছে। এভাবে বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ সুশাসন শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের কথা বলা যায়। কেননা বাংলাদেশের সুশীল সমাজ (Civil Society) দুর্নীতি হাস ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার সুশাসনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ সুশাসনের চারটি দিকের উল্লেখ করেছে। যথা:
১. সুশাসন হলো অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করা।
২. সুশাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ।
৩. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলেই শাসনব্যবস্থা উত্তম হবে। এ জবাবদিহিতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে করতে হবে।
৪. প্রশাসনিক দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে সুশাসনের প্রসঙ্গটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণমুখী প্রশাসনের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা আজ সর্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তার 'Development VS Freedom' গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন, "উন্নয়ন অর্থ হচ্ছে পরাধীনতার অবসান আর সামাজিক শান্তি নিশ্চিত করার উপায় হচ্ছে 'সুশাসন'।" তাই সুশাসনের বিষয়টি আজ পৌরনীতিতে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। সুশাসন আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ