- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল
ওয়ারেন হেস্টিংস নিয়ামক আইন (১৭৭৩ খ্রি.) Warren Hastings: Regulating Act (1773 AD)
ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকাল (১৭৭২-১৭৮৫) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাত্র আঠারো বছর বয়সে লর্ড ক্লাইভের ন্যায় তিনি কোম্পানির সামান্য কর্মচারী হিসেবে ভারতবর্ষে আসেন। সিরাজউদ্দৌলার কাশিমবাজার অভিযানকালে অনেকের ন্যায় তিনিও বন্দী হন এবং ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি লাভ করে স্বদেশে ফিরে যান। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতবর্ষে গভর্নর নিযুক্ত হন এবং পার্লামেন্টে Regulating act-1773 (নিয়ামক আইন ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) পাস হবার পর ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন। সে হিসেবে তিনিই প্রথম ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল।
হেস্টিংসের প্রাথমিক অসুবিধাসমূহ
ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস বেশ কতগুলো অসুবিধার সম্মুখীন হন। উল্লেখযোগ্য অসুবিধাসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
ক) ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোকের অকাল মৃত্যু ঘটে। ফলে বাংলার বহু গ্রাম ও সবুজ প্রান্তর উজার হয়ে যায় এবং উর্বর ভূমি পতিত হয়ে যায়।
খ) ক্লাইভের প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন নীতির ফলে দেশে প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, রাজকোষ শূন্য হয়।
গ) প্রশাসনিক দুর্বলতার জন্য কোম্পানির কর্মচারীগণ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
ঘ) দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তির উত্থান ব্রিটিশ শক্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে।
ঙ) মহীশূরের হায়দার আলী ব্রিটিশদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়নের এবং প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। এমনি এক বিপদসংকুল পরিবেশে হেস্টিংস বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। সে সময় বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক স্যার আলফ্রেড বলেন, দুর্নীতিতে উপমহাদেশের ইংরেজদের ভাগ্য সর্বনিম্ন স্তরে নিমজ্জিত ছিল।
হেস্টিংসের অভ্যন্তরীণ নীতি
হেস্টিংস ভারতবর্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধান করে। তার সংস্কারসমূহ উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নিম্নে তার অভ্যন্তরীণ নীতিসমূহ আলোচনা করা হলো-
দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান ক্লাইভ কর্তৃক প্রবর্তিত দ্বৈতশাসনের কুফলে বাংলায় ইংরেজদের মর্যাদা সর্ব নিম্নস্তরে নেমে আসে। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে জনগণের ওপর অত্যাচারের অভিযোগে হেস্টিংস বাংলা ও বিহারের ডেপুটি নবাবের পদ দুটি বাতিল করে রাজস্ব ও দেওয়ানি সংক্রান্ত সকল দায়িত্ব কোম্পানির অধীনে আনয়ন করেন। ইংরেজদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত বঙ্গের নায়েব নাজিম রেজা খান, বিহারের নায়েম নাজিম সিতাবর রায়কে পদচ্যুত করে বিচারের জন্য কলকাতায় প্রেরণ করেন।
রাজস্ব সংস্কার: এটি হেস্টিংসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। তিনি কালেক্টর উপাধিধারী ইংরেজ কর্মচারীদের হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার অর্পণ করেন। দুর্নীতি দমন ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য রাজকোষ মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করেন। বোর্ড অফ রেভিনিউ নামক একটি সংস্থা গঠন করে রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়গুলো উক্ত সংস্থার ওপর ন্যস্ত করেন। অতঃপর রাজস্ব নিলামে চড়িয়ে সর্বাপেক্ষা উচ্চ হারে রাজস্ব দিতে স্বীকৃত ব্যক্তিকে পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারা প্রদান করেন। এই ব্যবস্থাই ইতিহাসে পাঁচসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।পরবর্তীকালে এ ব্যবস্থার কুফল লক্ষ করে কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রচলন করেন।
বিচার বিভাগের সংস্কার হেস্টিংস বিচার বিভাগকে রাজস্ব বিভাগ থেকে পৃথক করে প্রত্যেক জেলায় একটি করে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন। দেওয়ানি বিচারের ভার কালেক্টরের হাতে এবং ফৌজদারি বিচারের ভার দেশীয় বিচারকের হাতে অর্পণ করেন। উক্ত মোকদ্দমার আপিলের জন্য তিনি কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালত এবং সদর নিজামত আদালত নামক দুটি উচ্চতর আদালত স্থাপন করেন। নবাব বা নাজিম ছিলেন ফৌজদারি আদালতের প্রধান গভর্নর এবং তার দুজন সদস্যের সমন্বয়ে দেওয়ানি আদালত গঠিত হয়।
অর্থনৈতিক সংস্কার দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন-(১) মোগল সম্রাট শাহ আলমের দেয় বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা ভাতা বন্ধ করে দেন (২) এলাহাবাদ ও কারা জেলা দুটি কেড়ে নিয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাকে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রদান করেন। (৩) বাংলার নবাবের বাৎসরিক বৃত্তি ৩২ লক্ষ মুদ্রা থেকে কমিয়ে ১৬ লক্ষ মুদ্রা করেন। (৪) অযোধ্যার নবাবের নিকট থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে রোহিলা যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্য ভাড়া দেন। এভাবে বিভিন্ন অসাধু উপায়ে অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিকট থেকে গৃহীত সকল ঋণ পরিশোধ করেন।
হেস্টিংসের পররাষ্ট্র নীতি
হেস্টিংস গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে পররাষ্ট্র বা সীমান্ত নীতি বিষয়ে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি লক্ষ করলেন যে, কোম্পানি ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ভারতবর্ষে ইংরেজদের অধিকার স্থায়ী করতে হলে দেশীয় রাজাদের যথাসম্ভব ইংরেজ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা প্রয়োজন, এজন্য তিনি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন।
অযোধ্যা নীতি: হেস্টিংসের বৈদেশিক নীতির মূল লক্ষ্যই ছিল যেকোনো উপায়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তিনি সম্ভাব্য মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অযোধ্যাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন। এ লক্ষ্যে তিনি সম্রাট শাহ আলমকে দেয় বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা বন্ধ করে দেন এবং তার নিকট থেকে (বারাণসির সন্ধি দ্বারা) কারা ও এলাহাবাদ কেড়ে নিয়ে বাৎসরিক ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাকে প্রদান করেন। এ সংক্রান্ত চুক্তিটির নাম 'বারাণসীর সন্ধি'। এ সন্ধিতে আরও উল্লেখ থাকে যে, প্রয়োজনবোধে ব্রিটিশ সৈন্য অযোধ্যার নবাবকে সাহায্য করবে এবং 'সে জন্য তাকে যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে। বারাণসীর সন্ধির ফলেই পরবর্তীকালে রোহিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
রোহিলা যুদ্ধ-১৭৭৪: রোহিলা যুদ্ধ হেস্টিংসের আমলে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বর্তমান যুক্ত প্রদেশের অধিবাসীগণ রোহিলা আফগান নামে পরিচিত ছিল। রোহিলা সর্দার হাফিজ রহমত মারাঠাদের ভয়ে অযোধ্যার নবাবের সাথে এই মর্মে চুক্তি করেন যে, মারাঠাদের বিরুদ্ধে রোহিলাদের সাহায্য করলে অযোধ্যার নবাবকে ৪০ লক্ষ টাকা প্রদান করা হবে। ঘটনাচক্রে রোহিলাগণ মারাঠা কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং চুক্তি মোতাবেক অযোধ্যার নবাব সৈন্য দিয়ে সাহায্যও করেন কিন্তু মারাঠাদের রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের ফলে তারা হঠাৎ সেনা ছাউনি গুটিয়ে স্বদেশে চলে যান। চুক্তি মোতাবেক নবাব রোহিলা সর্দারের নিকট ৪০ লক্ষ টাকা দাবি করলে রোহিলা সর্দার বিষয়টি বিবেচনা করতে বললেন। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ক্ষুব্ধ হয়ে ৪০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে রোহিলাদের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়ে হেস্টিংসের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এভাবে ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সৈন্যের সাহায্যে অযোধ্যার নবাব 'মিরনপুর কাটারার' যুদ্ধে রোহিলাদের পরাজিত এবং হাফিজ রহমতকে নিহত করে রোহিলাখণ্ড অযোধ্যার অন্তর্ভুক্ত করেন। ব্রিটিশ সৈন্য ভাড়ায় খাটানোসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য হেস্টিংসকে পরবর্তী সময় মহাঅভিযোগের (Impechment) সম্মুখীন হতে হয়। অর্থের বিনিময়ে ব্রিটিশ সৈন্য ভাড়া দিয়ে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে তিনি ভুল করেন। এ কারণকে কেন্দ্র করে তার পরিষদ কাউন্সিলারের সাথে তার দ্বন্দ্ব হয়। এতদসত্ত্বেও হেস্টিংস নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে কোম্পানির ঋণ পরিশোধ করেন এবং আয় বৃদ্ধি করেন। হেস্টিংসের নিম্নমানের কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতবাসীর কাছে অপ্রিয় হন। তার কর্মকাণ্ডের জন্য ইংল্যান্ডের আদালতে তিনি অভিযুক্ত হলেও লর্ড ক্লাইভ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশদের ভারতীয় উপনিবেশ রক্ষার এবং ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়করণে তার অবদান অস্বীকার করা যায় না।
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ-১৭৭৫: ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে (প্রথম যুদ্ধ ১৫২৬ ও দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৫৫৬ খ্রি.)
মারাঠাদের যে ক্ষতি হয়েছিল তা পেশোয়া মাধব রাওয়ের নেতৃত্বে পূরণ সম্ভব হয়। কিন্তু পেশোয়া মাধব রায়ের মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নারায়ণ রাও পেশোয়া পদ গ্রহণ করলে রঘুনাথরাও তাকে হত্যা করে নিজেকে পোশোয়া বলে ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে নারায়ণরাও-এর গর্ভবতী স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন। মাধব রাও নারায়ণ নামে পরিচিত এই শিশুর পক্ষে অধিকাংশ মারাঠা সর্দার পেশোয়া পদের জন্য মনোনয়ন দিলে মারাঠাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সুরাটের সন্ধি মোতাবেক ইংরেজরা রঘুনাথের পক্ষ অবলম্বন করলে ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠা ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তেলিগাঁও-এর যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়ে ওয়াড়গাও-এর সন্ধিশর্তে আবদ্ধ হয়। হেস্টিংস এই সন্ধি প্রত্যাহার করলে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। অবশ্য ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে সলবাইয়ের সন্ধির মাধ্যমে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ সন্ধির শর্ত মোতাবেক ইংরেজ অধিকৃত স্থানসমূহ মারাঠাগণ ফেরত পান এবং ইংরেজরা সলসেট বন্দর লাভ করেন। ইংরেজরা মাধব রাও নারায়ণকে পেশোয়া বলে স্বীকৃতি দেন এবং রঘুনাথকে বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা বৃত্তি প্রদান করেন।
এ যুদ্ধে ইংরেজদের তেমন লাভ নাহলেও তাদের মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে তাদের অর্থ ব্যয় হলেও ২০ বছরের মধ্যে মারাঠাদের সাথে আর কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। এই সুযোগে ইংরেজরা ফরাসি এবং মহীশূরের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

