• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-১৭৯৩ Permanent Settlement-1793

লর্ড কর্ণওয়ালিশের (১৭৮৬-৯৩) শাসনামলে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংস্কার হচ্ছে ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। যা বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ভূমি রাজস্ব নিলামে তুলে দেওয়া হতো এবং যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ রাজস্ব দিতে স্বীকার করতেন তাকে ৫ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। কিন্তু তাতে জমি উন্নয়ন, খাজনা ইত্যাদি বিষয়ে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। পাঁচসালা বন্দোবস্তের কুফল প্রতিকারের উদ্দেশ্যে হেস্টিংস একসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিলেন। তাতে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়।

এরূপ জমিদারির অস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সরকার, জমিদার ও প্রজা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ অসুবিধা দূর করার জন্য কর্ণওয়ালিশ যে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে খ্যাত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য

জমির অস্থায়ী বন্দোবস্ত দূর করার লক্ষ্যে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ-

(ক) জেলা কালেক্টরের ১৭৮৭-১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক সুপারিশ।

(খ) কর্ণওয়ালিশ ইংল্যান্ডের জমিদার পরিবারভুক্ত থাকায় তিনি চেয়েছেন ভারতবর্ষেও একটি জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হোক।

(গ) কর্ণওয়ালিশের রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য ছিল এদেশে রাজভুক্ত জমিদার শ্রেণির উদ্ভাবন করা। এর ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম হ্রাস পাবে এবং তারা ব্রিটিশদের Collaborator হিসেবে কাজ করবে।

(ঘ) কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যস্ততা কমবে, তাতে শাসনকার্যে যথেষ্ট সময় দেওয়া যাবে।

(ঙ) সর্বোপরি কোম্পানির অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

জমিজমার স্থায়ী বন্দোবস্তের লক্ষ্যে লর্ড কর্ণওয়ালিশ ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারের সাথে দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। দশসালা বন্দোবস্তের সাথে সাথে তিনি এ প্রতিশ্রুতিও দিলেন যে, কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন লাভ করতে পারলে এ বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হবে। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ সেপ্টেম্বর ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন এসে পৌঁছলে লর্ড কর্ণওয়ালিশ সবদিক বিবেচনা করে প্রচলিত দশসালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ততে পরিণত করেন।

এখানে উল্লেখ্য যে লর্ড কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্ভাবক ছিলেন না। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে কোম্পানির প্রতি এ সম্পর্কে নির্দেশ ছিল। তবে একথা সত্য কর্ণওয়ালিশ যদি এ বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত না নিতেন তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু নাও হতে পারত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যায় এবং দু বছর পরে বারাণসীতে প্রবর্তিত হয়। এ ব্যবস্থায় জমিদারগণ চিরদিনের জন্য জমির মালিক হলেন এবং রাজস্ব স্থায়ী করে দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট খাজনা প্রদান করে জমিদারগণ পুরুষানুক্রমে জমি ভোগ দখল করবার অধিকার পায়। খাজনা বাকি পড়লে জমির অংশবিশেষ বিক্রয় করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। কৃষকরা নিম্ন পর্যায়ের রায়েত পরিণত হলো, জমির ওপর থেকে অধিকার চিরতরে বাঞ্চিত হলো। নাজরানা ও বিক্রয় ফি বাতিল করা হলো।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক প্রবর্তীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনেক সুফল ছিল। উল্লেখযোগ্য সুফলগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১। জমির মূল্য ও উৎপাদন বৃদ্ধি: জমিদারগণ জমির স্থায়ী মালিক এবং খাজনার পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ায় জমিদাররা জমি উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। পতিত জমিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করেন। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়।

২। কোম্পানির বজেট প্রণয়নে সুবিধা জমিদারদের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কোম্পানি তার আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়। ফলে কোম্পানির বাৎসরিক বাজেট প্রণয়নসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়।

৩। পূর্বের ভূমি রাজস্বের কুফল দূরীকরণ: এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার ফলে ইতঃপূর্বে প্রবর্তিত বাৎসরিক পাঁচসালা কিংবা দশসালা বন্দোবস্তের যে সকল দোষ-ত্রুটি ছিল সেগুলো দূরীভূত হয়।

৪। ব্রিটিশ সরকারের জনপ্রিয়তা ও স্থায়িত্ব লাভ এ ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় প্রদেশগুলো সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে অগ্রসর হয়।

৫। জমিদারের আয়বৃদ্ধি: জমিদারগণ জমির স্থায়ী মালিক হওয়ায় এক-তৃতীয়াংশ জমি যা পূর্বে জঙ্গলময় ছিল তা আবাদ হয়। ফলে জমিদারের আয় বৃদ্ধি পায়। ইতোপূর্বে গত পঁচিশ বছর ধরে অস্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থার যে কুফল ছিল তা দূরীভূত হয়।

৬। রাজভুক্ত জমিদার শ্রেণির উদ্ভব: জমিদারশ্রেণি কোম্পানির নির্ভরযোগ্য সমর্থনে পরিণত হয়। ফলে জমিদার শ্রেণি ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মহাবিদ্রোহসহ সকল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় থাকে। ঐতিহাসিক সিনকার এ প্রসঙ্গে বলেন, "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অর্থনৈতিক কুফল রাজনৈতিক, সুফল দ্বারা পরিমার্জিত হয়।"

৭। ব্রিটিশ সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এ ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় প্রদেশগুলো সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে অগ্রসর হয়।

৮। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট বিত্তশালী ব্যক্তিরা এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেমন- খাল খনন, বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় স্থাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীতে প্রজাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা, গ্রাম-গঞ্জে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল

লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ত্রুটিমুক্ত ছিল না। বিভিন্ন দিক থেকে তার কুফল পরিলক্ষিত হয়। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১। জমি জরিপ না করে রাজস্ব নির্ধারণ জমি জরিপ না করে রাজস্ব নির্ধারণ করায় রাজস্বের পরিমাণ অত্যধিক হয় এবং জমিদারির প্রকৃত সীমা নির্ধারণ না হওয়ায় অসংখ্য মামলা মোকদ্দমা সৃষ্টি হয়।

২। সূর্যাস্ত আইন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম কুফল হচ্ছে 'সূর্যাস্ত আইন' (Sun Set Law) প্রবর্তন। নির্দিষ্ট দিনে সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে নির্ধারিত রাজস্ব ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট জমিদারদের প্রদান করতে হতো, অন্যথায় তাদের জমিদারি নিলামে তুলে অনাদায়ী রাজস্ব আদায় করে নেওয়া হতো। যে আইনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করেছিলেন তাই ইতিহাসে সূর্যাস্ত আইন নামে খ্যাত। এই আইনের ফলে অনেক প্রাচীন জমিদার তাদের জমিদারি হারায়।

৩। ইংরেজ সরকারের রাজস্ব ক্ষতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় জমির মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়নি। জমিদারগণ সরকারকে যে পরিমাণ জমি থেকে রাজস্ব দিতেন ৩৭,৫০,০০০ পাউন্ড; সেই পরিমাণ জমি থেকে তারা প্রজাদের নিকট থেকে আদায় করত ১,৩০,০০,০০০ পাউন্ড।

৪। জমি উন্নয়ন ব্যাহত কর্ণওয়ালিশ আশা করছিলেন জমির উন্নতি হবে কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি। জমিদারগণ জমির উন্নয়নে চেষ্টা না করে পাইক গোমস্তাদের হাতে জমিদারি ছেড়ে দিয়ে শহরে গিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করে।

৫। পাইক গোমস্তাদের অত্যাচার জমিদারদের অনুপস্থিতিতে পাইক-গোমস্তরা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য রায়তগণকে নানাভাবে উৎপীড়ন করতে থাকে, ফলে প্রজাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। এ ব্যবস্থায় এক প্রকার সামন্ত প্রথার সৃষ্টি হয়।

৬। রায়েতদের ওপর জমিদারের আইনি অত্যাচার কোম্পানিকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থতার জন্য জমিদাররা রায়েতকে দায়ী করেন। তাই জমিদারদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে 'হপ্তম আইন' পাস করে রায়েতদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি জমিদাররা দখল করার ক্ষমতা পান।

৭। মুসলমানরা অপূরণীয় ক্ষতির স্বীকার: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা জমিদারি হারায়, হিন্দুরা জমিদারি শুরু করে। উইলিয়াম হান্টার বলেছেন, "গত ৭৫ বছরের মধ্যে বঙ্গের মুসলমান পরিবারগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক হতে মুছিয়া গিয়াছে, নতুবা ইংরেজদের সৃষ্ট নতুন বণিক সমাজের নিচে এ সময় ঢাকা পড়িয়া রহিয়াছে।"

৮। রায়েতদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা জমিতে জমিদারের মালিকানাস্বত্ব স্বীকার করা হয় কিন্তু রায়েতের দখলীস্বত্ব স্বীকার করা হয় না। ফলে রায়েত ভূমি দাসে পরিণত হয়। কথায় কথায় জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকে। রায়েত তথা কৃষকদের সর্বনাশ করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অপেক্ষা আর কোনো উত্তম ব্যবস্থা ছিল না। ইস্টিনকারের মতে, "চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের স্বার্থ রক্ষা হয়, রায়েতদের স্বার্থহানি ঘটে। নতুন জমিদারদের দয়ার ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত কিন্তু ফল ভোগ করত জমিদাররা।"

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সংস্কার

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা কিছুটা গুরুত্ব উপলব্ধি হলেও সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের কাছে এ ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ বন্দোবস্তের মারাত্মক ক্ষতির দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন সময় আইন পাস করে তা সংস্কার বা সংশোধন করতে হয়েছে।

১। রাজস্ব আইন: ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ক্যানিং রায়েতদের স্বার্থে রাজস্ব আইন পাস করে অন্যভাবে রায়েতদের উচ্ছেদ করা বা খাজনা বৃদ্ধি করা বন্ধ করে দিলেন।

২। প্রজাস্বত্ব আইন: ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশ প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে রায়েত তথা প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা হয়।

৩। রায়তি স্থিতিবানস্বত্ব আইন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে এ আইন পাস করে জমিস্বত্ব বিক্রয়ের অধিকার রায়েতদের দেওয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল করে রায়েত বা প্রজাদের সাথে সরাসরি জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ