- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন : কোম্পানি আমল
ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ: টিপু সুলতান Anglo Mysore War: Tipu Sultan
টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে মহীশূরের ক্ষমতা দখল করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি মহীশূরকে ভারতবর্ষের একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন। ইংরেজদের সাথে হায়দার আলীর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময় তাঁর আকস্মিক স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মহীশূরের হাল ধরেন তার সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান। পিতার অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ ইংরেজদের সাথে পিতার চলমান দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন এবং বেদনোর ও ব্যাঙ্কানোর অধিকার করেন। অবশেষে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মনিটর মাধ্যমে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু টিপু সুলতান ইংরেজদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন।
টিপু সুলতান স্পষ্ট অনুধাবন করেছিলেন ইংরেজ শক্তি ভারতবর্ষের যেকোনো শক্তির পক্ষে আতঙ্কিত এবং অধিক বিপদের কারণ। তাই তিনি ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি ফ্রান্স, মরিশাস, কাবুল প্রভৃতি দেশের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। এর ফলে ইংরেজরা তাকে একনম্বর ভয়ানক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ভারতে ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপন করতে হলে টিপুকে পরাজিত করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। সে সময় সমগ্র ভারতে টিপু সুলতানের রাজ্য ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী। টিপু সুলতান ভারতে ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় শক্তি ফরাসিদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। পাশাপাশি তুরস্কের সুলতানের সাহায্য কামনা করেন। টিপু সুলতান ফ্রান্সের বিপ্লবী দল "জ্যাকোসিন ক্লাবের" সদস্য ছিলেন। টিপু সুলতান শ্রীরঙ্গপত্তমে "স্বাধীনতা বৃক্ষ" নামে একটি গাছের চারা রোপণ করেন যা তার স্বাধীনচেতা মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীর অনুকরণে এবং ফরাসি সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে একটি আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠন করেন, তিনি একটি আধুনিক নৌবাহিনীও গঠন করেছিলেন।
টিপু সুলতানের এ সকল প্রস্তুতি এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব ভারতের নতুন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিস আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি টিপুর রাজ্যের ওপর দৃষ্টি দেন। কেননা কর্ণওয়ালিস-এর কাছে মনে হয়েছিল যে, ইংরেজদের স্বার্থে বিশেষ করে মসনা ও চন্দন কাঠের জন্য 'মালাবা' ইংরেজদের দখলে নেওয়া প্রয়োজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ইংরেজ উপনিবেশ বিস্তারের জন্য কালিকট ও ক্যানন বন্দর দখল করা খুবই জরুরি ছিল। তাছাড়া এ পথ দিয়ে ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় সাথে নৌযোগাযোগ সবচেয়ে সহজ হবে। অন্যদিকে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটেন পরাজিত হয়ে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ হারিয়ে কর্ণওয়ালিস তথা ইংরেজরা বিষণ্ণ। তাই কর্ণওয়ালিস সদ্য ভারতে এসে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং ক্ষতিপূরণের জন্য টিপুর সমৃদ্ধ রাজ্য জয়ের পরিকল্পনা করেন।
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
লর্ড কর্ণওয়ালিশের শাসনকালে টিপু সুলতানের সাথে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাঙ্গলোরের সন্ধি দ্বারা দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। টিপু সুলতান উপলব্ধি করলেন যে, আজ হোক কাল হোক ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ হবেই। তাই তিনি গোপনে ফ্রান্স, কনস্টান্টিনোপল এবং মারিসারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিচক্ষণ কর্ণওয়ালিশ টিপু সুলতানকে বাদ দিয়ে নিজাম ও মারাঠাদের সাথে মিত্র সংঘ গঠন করলে টিপু রুষ্ট হন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে টিপু সুলতান ইংরেজদের মিত্র রাজ্য ত্রিবাঙ্কর আক্রমণ করলে কর্ণওয়ালিশ তার মিত্রদের নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ একবছর অবরোধের পর টিপু সুলতান পরাজিত হন। ইংরেজদের সাথে শ্রীরঙ্গপওমের সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী টিপু সুলতান তার রাজ্যের অর্ধেক এবং ৪ ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ইংরেজদের দিতে বাধ্য হন। ইংরেজ তার মিত্রদের মধ্যে উক্ত অর্ধেক রাজ্য ভাগ করে নেন।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের পরাজয়কে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে পারেনি টিপু সুলতান। টিপুর স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং সমর সজ্জায় সন্দিহান হয়ে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েলেসলি টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূরে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইংরেজ এবং নিজামের সম্মিলিত বাহিনী দুই দিক থেকে টিপুর রাজ্য আক্রমণ করেন। নিজাম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন লর্ড ওয়েলেসলির ভ্রাতা আর্থার ওয়েলেসলি এবং ইংরেজবাহিনীর নেতৃত্ব দেন সেনাপতি হ্যারিস। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক টিপু সুলতান বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই নিহত হন। এই দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধাকে পরাজিত ও নিহত করে ইংরেজরা স্বস্তি পেল। টিপুর রাজ্য তিন ভাগ করে দুই ভাগ ইংরেজ ও নিজামের মধ্যে বণ্টিত হলো এবং বাকি অংশ মহীশূরের রাজাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো যার নিকট থেকে হায়দার আলী রাজ্য দখল করেছিলেন।
টিপু সুলতানের কৃতিত্ব বিচার
ভারতবর্ষে টিপু সুলতান একটি নাম, একটি ইতিহাস। ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে তিনি যে বীরত্ব এবং নির্ভীকতার প্রমাণ রেখে গেছেন তা ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশীয় কাপুরুষ শাসকদের ব্রিটিশ তোষণনীতির ফলে সেদিন তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি, তথাপিও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতা অর্জনের চেতনায় যে বীজ বপন করে যান তা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। বীরত্বের জন্য তাকে 'মহীশূরের ব্যাঘ্র' আখ্যা দেওয়া হয়। তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের 'আশার শেষ রশ্মি' বলা হয়। একজন বীর যোদ্ধা ও সুশাসক হিসেবে টিপু কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি পিতা হায়দার আলীর সাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে জয় লাভ করে খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূরের যুদ্ধে তার, ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। তার মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের মাটি থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করা। টিপু নিজে বলতেন "শৃগালের মতো একশ বছর রাজত্ব করা অপেক্ষা সিংহের মতো একদিন রাজত্ব করা অনেক সম্মানজনক।" তিনি একজন সুশাসক হিসেবেও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় তৎকালীন মহীশূরে কৃষির ব্যাপক উন্নতি, বাণিজ্যিক প্রসার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। তার সেনাবাহিনীর সমর সজ্জা ও যোগ্যতা তৎকালীন পৃথিবীর যেকোনো দেশের সাথে তুলনা করা যেত। ইংরেজরা তার জনপ্রিয়তায় ঈষান্বিত হয়ে তার চরিত্র নানাভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক পি.ই. রবার্ট তাকে 'নৃশংস বর্বর' বলে বর্ণনা করেছেন। আলফ্রেড লায়ালের মতে, "টিপু সুলতান ছিলেন অশিক্ষিত ও ধর্মান্ধ।" কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবনে টিপু সরল, বিদ্বান, অনাড়ম্বর এবং ধর্মীয় উদারতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি উর্দু, ফারসি এবং কানাড়ি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ভারতবর্ষের মাটিতে যে ক'জন দেশপ্রেমিক অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে টিপু সুলতান নিঃসন্দেহে অন্যতম।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

