• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় বঙ্গভঙ্গ

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা হলে উভয় বাংলার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনুন্নত ও অবহেলিত পূর্ব বাংলার মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায় কিন্তু পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা এর বিরোধিতা করে। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে নব নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারকে ঢাকায় বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কংগ্রেস ঐ দিন (১৬ অক্টোবর) দেশব্যাপী শোক দিবস পালন করে। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার উন্নয়নের বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে এর বাস্তবায়নে বাংলার ভাগ্যাকাশে যে প্রাণ পুরুষের আবির্ভাব হয় তিনি হলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ।

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব বাংলার অবহেলিত মুসলমানদের তথা সমগ্র ভারতের নিপীড়িত ও অবহেলিত মুসলমানদের মুক্তির দিশারিরূপে আবির্ভূত হয়। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষগণ ব্যবসা উপলক্ষে এদেশে আসেন এবং জমিদারি ক্রয় করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই পরিবার জনহিতকর কাজের জন্য বেশ সুনাম অর্জন করে। যে কারণে সলিমুল্লাহ পিতামহ খাজা আবদুল গনি ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক 'নবাব' উপাধি লাভ করেন। এই উপাধিই তাদের বংশগত পদবিতে পরিণত হয়। খাজা আবদুল গনি তার পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামে ঢাকার ইসলামপুরে (১৮৫৯-১৮৭২) আহসান মঞ্জিল তৈরি করেন (২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২)। পরবর্তীতে এটিকে সরকারি জাদুঘরে পরিণত করা হয়। প্রতিদিন হাজার হজার দর্শনার্থী এটি দর্শন করে নবাবদের আভিজাত্য ও রুচিশীলতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে আহসানউল্লাহ মৃতবরণ করলে পারিবারিক দায়িত্ব পুত্র সলিমুল্লাহর ওপর বর্তায়। তখন তার বয়স ৩০ বছর। এসময় তিনি ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন। তার উদার পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়), মিটফোর্ট হাসপাতাল (বর্তমান সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ), সলিমুল্লাহ এতিমখানা, ঢাকা কলেজ হোস্টেল (বর্তমান সলিমুল্লাহ হল) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা তার জনহিতকর কাজের স্বাক্ষর বহন করে। শুধুমাত্র তার প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিনি সদিচ্ছা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবকে দৃঢ়তার সাথে সমর্থন করেছিলেন। তিনি বলেন, "বঙ্গভঙ্গ আমাদেরকে নিষ্ক্রিয় জীবন থেকে জাগিয়ে তুলেছে এবং সক্রিয় জীবন ও সংগ্রামের পথে ধাবিত করেছে।" অন্যদিকে, নতুন প্রদেশের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশার সৃষ্টি করে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

অপরদিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুরা নেমে আসে। রবিঠাকুরের পরামর্শে 'রাখি বন্ধন' আত্মশুদ্ধির জন্য 'গঙ্গাস্নান' অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়। বাঙালির ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বাংলার মাটি, 'বাংলার জল' গানটি রচনা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করলেন বন্দে মাতারম গান, 'বাহুতে তুমি মা শক্তি/হৃদয় তুমি মা ভক্তি' এটাই ভারতের জাতীয় সংগীত। হিন্দু সম্প্রদায় সরকারি চাকরি ইস্তফা প্রদান, বিলাতি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন-

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অশ্বিনী কুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, রাসবিহারী ঘোষ, অরবিন্দু ঘোষ, মারাঠা নেতা বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখ। আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। এ সময় পশ্চিম বাংলায় প্রকাশিত ইংলিশম্যান, স্টেটম্যান, যুগান্তর, সন্ধ্যা, হিতবাদী প্রভৃতি পত্রিকায় ও বক্তৃতায় বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি বিরোধী জাতীয়তাবাদ বিরোধী পদক্ষেপ এবং 'বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ' প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। হিতবাদী পত্রিকায় (৭-৭-১৯০৫) বলা হয়, গত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙালি জাতির সম্মুখে এরূপ বিপর্যয় আসেনি। হিন্দু নেতারা এটিকে 'জাতীয় দুর্যোগ' এবং বাঙালি (হিন্দু) জাতীয়তাবাদের সংকটময় মুহূর্ত বলে অভিহিত করেন। মহারাজা মহীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মতে, "নতুন প্রদেশের মুসলমানরা হবে সংখ্যাগুরু আর বাঙালি হিন্দুরা হবে সংখ্যালঘু। ফলে স্বদেশেই আমরা হব প্রবাসী।"

পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতার কারণ হিসেবে বলা যায়-

(ক) বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যের ব্যাপক উন্নয়ন হবে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হবে। এর ফলে হিন্দু জমিদার ও বুদ্ধিজীবীরা মুসলমানদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব হারাবে।

(খ) পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হিন্দুরা মেনে নিতে পারেনি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে তাদের মনে দারুণ ঈর্ষার উদ্রেক হয়। এ কারণে বঙ্গ বিভাগকে নানান রঙে রঙিন করে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

(গ) ঢাকায় নতুন রাজধানী হলে এতদ্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাবে, কলকাতার সমৃদ্ধি হ্রাস পাবে, সেখানের শিল্পপতি ও পুঁজিবাদীদের একচেটিয়া ব্যবসায় বিঘ্ন ঘটবে।

(ঘ) কলকাতার আইনজীবীগণ মনে করেন, ঢাকায় নতুন হাইকোর্ট হলে তাদের ব্যবসায় ভাটা পড়বে। কারণ অধিকাংশ মক্কেলই ছিল পূর্ববঙ্গের।

(ঙ) কলকাতার সাংবাদিকরা মনে করেন, নতুন প্রদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে পত্রিকা বের হবে, সেক্ষেত্রে তাদের পত্রিকার চাহিদা কমে যাবে।

এভাবে শ্রেণিগত স্বার্থহানির আশঙ্কায় কলকাতায় হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ