- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন Indian Government Act of 1935
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দলিল। ১৮৬১ থেকে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য যে কয়টি আইন পাস করেন সেগুলোর মধ্যে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের সংস্কার আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা আংশিকভাবেও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেহেরু রিপোর্ট এবং মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে জিন্নাহর ১৪ দফা সবকিছু মিলিয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে। কংগ্রেসের 'আইন অমান্য আন্দোলন' প্রত্যাহার করলে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্ত কমিটি সম্পর্কিত প্রস্তাবাবলির যথোপযুক্ত রদবদল সাপেক্ষে রিপোর্ট প্রদান করেন। উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করেন।
উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইনে যে ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল তা ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের আইনের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন অত্যন্ত দীর্ঘ এবং জটিল একটি দলিল।
সুবৃহৎ এই আইনে মোট ধারা ছিল ৩২১টি। নিম্নে এ আইনের প্রধান ধারাসমূহ বর্ণনা করা হলো-
১. যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতে প্রচলিত এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে ১১টি প্রদেশ ও যোগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্যসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
২. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রতিষ্ঠা এ আইনে একজন প্রধান বিচারপতি এবং কয়েকজন সহযোগী বিচারপতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এ আদালতের কাজ ছিল সংবিধানের ব্যাখ্যা দান এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে বিরাজমান বিবাদের মীমাংসা করা।
৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন একান্ত অপরিহার্য। এই আইনে দ্বৈত শাসন রহিত করা হয় এবং দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন করা হয়।
৪. প্রাদেশিক আইনসভা গঠন এই আইনে বাংলা, বিহার, আসাম, মুম্বাই, মাদ্রাজ এবং যুক্ত প্রদেশকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট এবং অন্য ৫টি প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন করা হয়।
৫. প্রত্যেক প্রদেশের জন্য গভর্নর পদ সৃষ্টি: এই আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রদেশের জন্য গভর্নর পদ সৃষ্টি করা হয়। গভর্নর প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন এবং উপেক্ষাও করতে পারতেন।
৬. নতুন প্রদেশের সৃষ্টি এই আইনে সিন্ধু ও উড়িষ্যা নামে দুটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয় এবং অন্যান্য প্রদেশের মতো সমমর্যাদা দেওয়া হয়। ব্রহ্মদেশকে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
৭. কেন্দ্রীয় দ্বৈতশাসন প্রবর্তন কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহকে সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত এই দু'ভাগে ভাগ করা হয়। সংরক্ষিত বিষয়সমূহকে ৩ জন উপদেষ্টার সাহায্যে গভর্নর জেনারেল তার ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করতেন এবং হস্তান্তরিত বিষয়সমূহকে মন্ত্রিসভার সাহায্যে পরিচালনা করতেন।
৮. দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এই আইনের দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চ কক্ষের নাম রাষ্ট্রীয় পরিষদ এবং নিম্ন কক্ষের নাম ব্যবস্থা পরিষদ রাখা হয়।
৯. ক্ষমতা বণ্টন: আইনগুলোকে (ক) কেন্দ্রীয় (খ) প্রাদেশিক এবং (গ) যুগ্ম এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল দেশরক্ষা, বৈদেশিক, মুদ্রা, ডাক যোগাযোগ সহ ৫৯টি। প্রাদেশিক বিষয় ছিল আইন, শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ সহ ৫৪টি এবং যুগ্ম বিষয় ছিল ফৌজদারি আইন, বিবাহ বিচ্ছেদ, উইলসহ ৩৬টি। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারের আওতাভুক্ত ছিল।
১০. ভারত সচিবের ক্ষমতা হ্রাস এই আইনে ভারত সচিবের পরিদর্শন নির্দেশ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা উল্লেখ না থাকায় ক্ষমতা হ্রাস পায়।
১১. সাংবিধানিক সংশোধন সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা ভারতে কেন্দ্রীয় আইনসভার পরিবর্তে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
১২. গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা: এই আইনের বলে গভর্নর জেনারেল ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান নির্বাহী, ব্রিটিশ রাজার প্রতিনিধি। সুতরাং তার প্রচুর ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছিল। ফলে এই আইনে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৩. মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন: এই আইনে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে একতৃতীয়াংশ মুসলমান প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়।
১৪. উপদেষ্টা সংস্থা গঠন: এই আইনের মাধ্যমে ভারত সচিবের কাউন্সিল বিলুপ্ত করা হয় এবং স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা গঠন করা হয়।
১৫. রাজপ্রতিনিধির পদ সৃষ্টি: এই আইনে দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য রাজপ্রতিনিধির পদ সৃষ্টি করা হয়।
১৬. বার্মার পৃথকীকরণ: পূর্বে বার্মা ভারতের সাথে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু এই আইনের বলে বার্মাকে ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করা হয়।
সমালোচনা
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন ব্রিটিশ কমনওয়েলথে ভারতের শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দান করেনি। এই আইন মুসলিম লীগ কিংবা কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়নি। কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহেরু এ আইনকে 'অবাঞ্ছিত, অগণতান্ত্রিক, জাতীয়তা বিরোধী এবং দাসত্বের নতুন সনদ' আখ্যায়িত করেন। রাজা গোপাল আচারিয়ার মতে, 'এ আইন দ্বৈতশাসন অপেক্ষাও খারাপ ছিল'। এ.কে. ফজলুল হক এই আইনকে 'না হিন্দুরাজ, না মুসলমানরাজ' বলে সমালোচনা করেন। এ আইন ছিল হতাশাব্যঞ্জক, এতে ডোমিনিয়ন মর্যাদার কথা পর্যন্ত বলা হয়নি। এতদসত্ত্বেও এই আইন দাসত্বের নতুন সনদ নয় বরং ভারতবাসীর দাবি আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপের স্বাক্ষর বহন করে। ভারতের প্রদেশগুলোতে সীমাবদ্ধ আকারে হলেও দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কাজে লেগেছিল।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

