• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

বৈপ্লবিক আন্দোলন Revolutionary Movement

আন্দোল স্বদেশী আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের চরমপন্থী দল 'স্বরাজ' ধ্বনি তুলে বৈপ্লবিক আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের পতন ঘটানো। এ সময় বাংলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু 'গুপ্ত' সমিতি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ঢাকার 'অনুশীলন সমিতি' যার প্রধান ছিলেন পুলিন বিহারী দাস, কলকাতার 'যুগান্তর পার্টি' যার প্রধান ছিলেন রবীন্দ্র কুমার ঘোষ। এ সংগঠনের সদস্য ছিল বাংলার যুবক সম্প্রদায়, যারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের পতন ঘটাতে চায়। এ সমিতির মুখপাত্র ছিল 'যুগান্তর' পত্রিকা। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্র ঘোষ, পুলিন দাস ও প্রতুল গাঙ্গুলী।

প্রথম পর্যায়: বিপ্লবীরা ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর এন্ডু ফ্রেজার এবং পূর্ব বাংলা ও আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর বিপ্লবীরা টার্গেট করে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি আলীপুরে কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ করে বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু কিংসফোর্ড গাড়িতে ছিল না, ছিল অন্য এক ইংরেজ কর্মকর্তার স্ত্রী কেনেডি ও কন্যা। তারা নিহত হয়। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন এবং তার ফাঁসি হয় (১৯০৮)। প্রফুল্ল চাকি নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ সময় ক্ষুদিরামকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বিখ্যাত এই গান- "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি-হাসি পড়ব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।" ১৯০৮-১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বহু ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়: বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয় ১৯১২ সালে। এ আন্দোলন কলকাতা কেন্দ্রিক হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সময় কলকাতায় গোপনে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। ১৯১২ সালের শেষের দিকে দিল্লিতে রাসবিহারী বসুর পরিকল্পনায় লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার জন্য বোমা হামলা চালানো হয়। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এ সুযোগে বাংলার অনেক বিপ্লবী বিদেশ থেকে গোপনে অস্ত্র সংগ্রহের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইংরেজ শক্তির সাথে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এঁদের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতিন), ডা. যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ। সরকার গোপনে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে চিত্তপ্রিয় নামে একজন বিপ্লবী শহিদ হন। বাঘা যতিনের জেলখানাতেই মৃত্যু হয় এবং অপর দুই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়। এতো জেল-জুলুম, হত্যা, ফাঁসি দিয়েও বিপ্লবীদের টলানো যায়নি। তাঁদের শক্তি ছিল 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি। বিপ্লবীরা চোরাগোপ্তা হামলা, বোমা নিক্ষেপ অব্যাহত রাখে। ১৯১৬ সালের ৩০ শে জানুয়ারি বিপ্লবীরা হত্যা করে পুলিশের ডেপুটি সুপার বসন্ত চট্টোপাধ্যায়কে। হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকলে গ্রেফতার বাড়তে থাকে। ১৯২২ সালে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতার আরও বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে অক্টোবর মাসে ইংরেজ সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি করে। এ অর্ডিন্যান্স বলে বহু বিপ্লবী কারারুদ্ধ হয়। এর ফলে এ পর্বের আন্দোলনও স্থিমিত হয়ে পড়ে।

তৃতীয় পর্যায়: ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের সাথে সাথে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন আবার মাথাচারা দিয়ে ওঠে। এ সময় বিপ্লবীরা কঠিন থেকে কঠিতর হয়ে ওঠে। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বাঙালি যুব সমাজ বারবার সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় একজন দুঃসাহসী বিপ্লবী ছিলেন চট্টগ্রামের মাস্টারদা। তার আসল নাম সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪) কলেজ জীবনে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। স্নাতক ডিগ্রি পাশের পর তিনি উমেতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। তিনি একজন পরিপূর্ণ শিক্ষক হয়ে ওঠেন এবং সকলের কাছে মাস্টারদা নামে পরিচিত হন। এই মাস্টারদা সূর্য সেন অম্বিকা চক্রবর্তী, অনুরুপ সেন, নগেন সেনর সহযোগিতায় একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। তার সংগঠন বিভিন্ন কৌশলে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান। এজন্য তিনি গ্রেফতারও হন। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়া পান। চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে তিনি চট্টগ্রাম বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলেন। এটি একটি আত্মঘাতী বাহিনী। পরে এ বাহিনীর নাম হয় "চিটাগাং রিপাবলিকান আর্মি"। সূর্য সেনের বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার বিপুল বাহিনী প্রস্তুত করে। জালালাবাদ শহরে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে বিপ্লবীরা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ অভিযানে অনেক বিপ্লবীরা নিহত হন।

সূর্য সেনের বিপ্লবীদেন মধ্যে নারী যোদ্ধারা ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ছিল ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করা। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে নিচ্ছিদ্র প্রহরীর ব্যবস্থা ছিল। এই ক্লাবে একমাত্র শ্বেতাঙ্গ (ব্রিটিশ) ছাড়া অন্য কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। ক্লাবের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, "ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড" (কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ)। নির্দিষ্ট দিনের (২৩ শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২ খ্রি.) আট দিন আগে পুরুষ বেশে কল্পনা দত্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব বর্তায় একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার ওপর। ২৩ শে সেপ্টেম্বর আক্রমণের দিন প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, চুল ঢেকে রাখার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রাবার সেলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের সামনে পাঞ্জাবিদের কোয়ার্টার থাকায় প্রীতিলতার পাঞ্জাবি ছেলেদের মতো এরূপ ছদ্মবেশ। আক্রমণে অংশ নেওয়া অন্যান্যদের মধ্যে কালী কিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তীর পোশাক ছিল ধুতি আর শার্ট। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় ৪০ জন ব্রিটিশ সে দিন ক্লাবে উপস্থিত ছিল। রাত ১০টায় সাথিদের নিয়ে প্রীতিলতা পূর্ব গেইট দিয়ে ক্লাবে প্রবেশ করেন। হাতে ছিল রিভলবর ও বোমা। অন্ধকারে আক্রমণের এক পর্যায় এক ইংরেজের পিস্তলের গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার বাম পাঁজরে। সে অবস্থায় আক্রমণ সমাপ্ত করে বেরিয়ে পড়েন। মারাত্মক আহত অবস্থায় সঙ্গীদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে ধরা দেন এবং ধরা দেওয়ার পূর্বে পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে আত্মহত্যা করেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

সূর্য সেন ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে পালাতে সক্ষম হন। তাঁকে ধরার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ চট্টগ্রামের গৈরলায় ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সূর্য সেন ও ব্রজেন সেনকে গ্রেফতার করে। পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ হয়, "চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সম্পর্কে ফেরারি সূর্য সেন গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেফতার হইয়াছে।" ১৯৩৪ সালে সংক্ষিপ্ত ট্রাইব্যুনালে বিচারে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। চরম নির্যাতনের পর ঐ বছরের ১২ই জানুয়ারি তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁর মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনদের কাছে হস্তান্তর না করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে বুকে লোহা বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। দেশপ্রেমিক সূর্য সেনের নাম ইতিহাসে চির অম্লান।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ