- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন-১৯১৯ The Term of the Mont-Ford Reform-1919
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন উপমহাদেশের জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। অতঃপর ভারত সচিব মন্টেগু ও বড়লাট চেমসফোর্ড-এর যৌথ উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি সংস্কার আইন প্রণয়ন করা হয়। তাদের নামানুসারে এই সংস্কার আইনের নাম হয় মন্টেও-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন।
উদ্দেশ্য
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সচিব মন্টেগু ও বড়লাট চেমসফোর্ড কর্তৃক এ সংস্কার আইন প্রণয়নের কতগুলো উদ্দেশ্য ছিল। এ আইনের উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ-
১। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আইনের ত্রুটি: ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার আইনে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ করা সম্ভব হয়নি, ভারতীয়দের বিক্ষোভের অবসানও ঘটাতে পারেনি। এই আইনে মুসলমানদের পৃথক সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হলে কংগ্রেস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
২। বঙ্গভঙ্গ রদ: ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করলে মুসলমানরা হতাশাগ্রস্ত হয়। ফলে উভয় জাতি ব্রিটিশ শাসনের প্রতি হয়ে পড়ে ভীতশ্রদ্ধ।
৩। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি: ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড জড়িয়ে পড়লে যুদ্ধ জয়ের জন্য উপমহাদেশের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ আইনের মাধ্যমে উপমহাদেশের অধিবাসীদের ব্রিটিশদের পক্ষে নেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
৪। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের লক্ষ্ণৌ চুক্তি: এ চুক্তির ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হলে ব্রিটিশ সরকারের ভেদ নীতি অচল হয়ে পড়ে। এই সময় ব্রিটিশ সরকার তুর্কি-ইতালি যুদ্ধে ইতালির পক্ষ নিলে মুসলিম জগতে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা উপলব্ধি করল, শীঘ্রই একটি ঘোষণা দ্বারা ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করা দরকার। তারই একটি কার্যকরী উদ্যোগ ছিল মন্ট-ফোর্ট সংস্কার আইন-১৯১৯।
ধারাসমূহ
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের প্রধান প্রধান ধারাসমূহ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো-
১। ধাপে ধাপে ভারতে দায়িত্বশীল সরকার গঠন করা হবে। এই উদ্দেশ্যে আপাতত প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে।
২। বিলাতে হাই কমিশনের পদ সৃষ্টি করে তার হাতে ভারত সচিবের কাজের কিছু দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
৩। ভারত সচিবের ক্ষমতা বাড়িয়ে ভারত সরকারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করা হয়।
৪। বড়লাটের শাসন পরিষদের ৮ জন সদস্যদের মধ্যে ৩ জনকে ভারতীয় সদস্য হিসেবে বড়লাট মনোনয়নের অধিকার পান। এই সদস্যদের হাতে আইন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৫। এই আইনে সর্বপ্রথম ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
৬। কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠিত হয়। উচ্চ কক্ষের নাম হয় Council of State (রাষ্ট্র পরিষদ) এবং নিম্ন কক্ষের নাম হয় Legislative Asembly (ব্যবস্থাপকের সভা/আইন পর্ষদ)।
৭। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কার্যকাল ৩ বছর এবং ব্যবস্থাপক পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর করা হয়। ধনী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আইনসভায় ভোট দানের অধিকার দেওয়া হয়।
৮। মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। ক্ষেত্র বিশেষ শিখ, ইউরোপীয় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় খ্রিষ্টানদের মধ্যেও সম্প্রসারণ করা হয়।
৯। এ আইনে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন একটি উল্লেখযোগ্য দিক। প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়াদিকে সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১০। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলায় ১৪০, মাদ্রাজে ১৩২, মুম্বাই ১৪৪, উত্তর প্রদেশে ১২৩ জন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে অন্তত ৭০% নির্বাচিত হবেন। সরকারি কর্মচারী ২০% বাকি ১০% বেসরকারি মনোনীত।
১৯১৯ সালে মন্ট-ফোর্ড সংস্কার আইন ভারতীয় জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এ আইনটি মধ্যপন্থী এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছাড়া সকল ভারতীয়দের মধ্যে গভীর অসন্তোষ এবং হতাশার সৃষ্টি করে। মিসেস বেশান্ত এ আইন সম্পর্কে তার 'New India' বইতে মন্তব্য করেন, The Scheme was Ungenerous for England to after and unworthy for Indian to accept. বালগঙ্গাধর তিলক এ আইন সম্পর্কে বলেছেন, "আইনটি একটি সূর্যলোকহীন প্রভাতের সৃষ্টি করে।" অবশ্য অধ্যাপক জি.এন সিং মন্তব্য করেছেন, The Constituted the first step on the road to self government. এ আইন ভারতীয়দের কতটুকু সন্তুষ্ট করেছিল সে প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে এই আইনের দোষ ও গুণ আলোচনা করতে হবে-
দোষসমূহ
মন্টেও চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের যথেষ্ট ত্রুটি লক্ষ করা যায়। যেমন-
১। কেন্দ্রে কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভার ব্যবস্থা এই আইনে ছিল না। বড়লাটের শাসন পরিষদের ৩ জন ভারতীয় সদস্যদের তিনি মনোনয়ন করায় তারা তার অনুগত হয়ে কাজ করেন। এই সদস্যদের ওপর কেন্দ্রীয় আইনসভার কোনো এখতিয়ার ছিল না।
২। বড়লাটের হাতে এত বেশি জরুরি ক্ষমতা দেওয়া হয় যে, এই ক্ষমতার জোরে তিনি আইনসভার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন। কোনো আইন প্রস্তাব আইনসভা নাকচ করলে তিনি অর্ডিন্যান্স ও সার্টিফিকেটের জোরে তা বৈধ করে নিতেন। সদস্যদের আলোচনার অধিকারও তিনি সীমাবদ্ধ করতে পারতেন।
৩। কেন্দ্রীয় আইনসভায় একমাত্র ধনবান লোকেরাই ভোট দিতে পারত। সুতরাং কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি।
৪। প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে আইন প্রণয়ন এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইন পরিষদের কোনো ক্ষমতা ছিল না। বাজেটের ৬০%-এর ওপর কোনো ভোটাভুটি করা চলত না। ৪০%-এর ওপর আইনসভা পাস না করলেও বড়লাট পাস করে নিতে পারতেন।
৫। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে দপ্তর বণ্টনের সময় কেন্দ্রকে সিংহভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো দেওয়া হয়; যা ছিল খুব ত্রুটিপূর্ণ।
গুণসমূহ
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের গুণ হিসেবে বলা যায়-
প্রথমত, এই আইন দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রথা প্রবর্তিত হয় এবং ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করা হয়।
দ্বিতীয়ত, আইনসভার নিকট দায়ী মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যার মাধ্যমে দায়িত্বশীল সরকারের সূচনা হয়েছিল।
তৃতীয়ত, এই আইনের বলে জনসাধারণ রাজনৈতিক ও শাসন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায়। টম্পসন ও গ্যারাটিও বলেছেন, "প্রদেশে ভারতীয়দের মন্ত্রী নিয়োগ করে সরকারের ভারতীয় করণের পথ প্রশস্ত করা হয়।"
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই আইনের কাছ থেকে ভারতীয় জনগণ যতটুকু সাফল্য আশা করেছিল তা পূরণ হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, যখনই ব্রিটিশ সরকার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তখনই একটা সংস্কারের অজুহাত নিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার আইন যে ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি তার বড় প্রমাণ ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত শাসন আইনের প্রয়োজনীয়তা। কংগ্রেসের চরমপন্থিরা এই আইনকে 'অসন্তোষজনক, অপ্রচুর ও হতাশাজনক' বলে সমালোচনা করেছেন।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

