• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

লাহোর প্রস্তাব-১৯৪০ Lahore Proposal-1940

লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ১৯২৮ সালের নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশের সময় থেকে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক ও প্রশাসনতান্ত্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য দলীয় অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ২৩ মার্চ, ১৯৪০ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে বাংলার কৃতি সন্তান শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তাই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব বা 'পাকিস্তান' প্রস্তাব নামে খ্যাত। মূলত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য। সংবিধানে এসব রাষ্ট্রসমূহে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার বিধান রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি (The Background of the Lahore Resolution)

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা পরিকল্পনা চূড়ান্তভাবে বাতিল করার জন্য মুসলিম লীগ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এ সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা চিরদিনের জন্য অগ্রহণযোগ্য একটি পরিকল্পনা। কারণ ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের আইনে বিভিন্ন জাতিকে নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমগ্র জনগণের উপযোগী ছিল না। এ অবস্থায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ এমন এক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, যার ফলে ভারতীয় মুসলমানরা স্বীয় সংস্কৃতি ও জীবন ধারাকে অব্যাহত রেখে ভারতের বুকে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে সক্ষম হবে। এ দৃঢ় সংকল্পের মূলে ছিল ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং কংগ্রেসের অসহিষ্ণু মনোভাব। ১৯৩৭খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে হিন্দু প্রধান দেশগুলোতে কংগ্রেস জয়ী হয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে। মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। এ অবস্থায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দাবি উঠতে থাকে মুসলমানরা কোনো সম্প্রদায় নয়, ভারতবর্ষে তারা এক স্বতন্ত্র জাতি। আন্তর্জাতিক সমাজে প্রত্যেক জাতির যেমন আত্মত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকে তেমনি ভারতবর্ষের মুসলমানদের সে অধিকার রয়েছে। শুধু ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচারই তাদের স্বতন্ত্র নয়, এলাকার ভিত্তিতে কিছু অংশে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ সকল এলাকার সমন্বয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক এক রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে।

এমতাবস্থায় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের দলীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য তুলে ধরা হলো:

লাহোর প্রস্তাব (The Lahore Resolution)

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশনের সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকরী করা যাবে না বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি তা নিম্নরূপ মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়। যথা:

ক. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

খ. এসব অঞ্চলকে প্রয়োজনমতো সীমা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে অঞ্চলসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র রাষ্ট্রসমূহ (Independant states) গঠন করতে পারে। এবং

গ. এ স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করতে হবে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা যে সকল স্থানে সংখ্যালঘু সে সকল স্থানে তাদের ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করতে হবে। লাহোর প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রয়োজনমত অন্যান্য বিষয়ে সর্বক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।

লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য (Feature of The Lahore Resolution)

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

১। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইনে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে পরিহার করে ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পাশাপাশি এলাকাসমূহকে পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

২। মুসলমানদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া আর কোনো সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

৩। ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন বা সন্নিহিত এলাকাগুলো পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

৪। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে।

৫। এই স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলো হবে সম্পূর্ণরূপে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

৬। সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৭। দেশের যেকোনো ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

৮। অঞ্চল বা প্রদেশগুলো নিজেদের এলাকার প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র যোগাযোগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে সকল ক্ষমতার অধিকারী হবে।

লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য

লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এবং এর ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলমানদের পৃথক আবাসস্থলের পরিকল্পনা দানা বাঁধতে থাকে। যার পরিণতিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। এ প্রস্তাব এটা প্রমাণ করে যে, ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সম্পূর্ণ পৃথক দুটি জাতি। এদের কৃষ্টি, কালচার, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার, ভারতের মুসলমানদের উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা ও কৃষ্টিগত পার্থক্য থাকায় একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের জাতির জনক কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একাধিক রাষ্ট্রের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা উল্লেখ করেন। ফলে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

লাহোর প্রস্তাবের ফলেই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তির পথ রচিত হয়। যদি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ লাহোর প্রস্তাবে একাধিক রাষ্ট্রের কথা বাদ না দিতেন তাহলে হয়তোবা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দেই মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তস্নাত বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তর এবং সর্বোপরি একাত্তর হয়তো বা সৃষ্টি হতো না। সে যাই হোক, এ কথা অবধারিত যে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পাকিস্তান সৃষ্টি এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ