• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল
ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন: ব্রিটিশ আমল

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন Independence Act of India of 1947

ভারতীয়দের দীর্ঘ সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এটাই ইতিহাসে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন বা ভারত স্বাধীনতা আইন নামে বিখ্যাত।

মুসলিম লীগ কর্তৃক মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর লর্ড ওয়াভেলের আহ্বানে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। উক্ত সরকারে প্রথমে মুসলিম লীগ যোগদান না করলেও পরে যোগদান করেন। কিন্তু উভয় দলের মধ্যে অসহযোগিতা ও মতানৈক্যের ফলে অন্ত বর্তীকালীন সরকারের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করে বলেন যে, "কংগ্রেস" ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এবং পালটা সরকার গঠন করবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনো রাজস্ব প্রদান করবে না। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ মুসলমানরা ভারতের সর্বত্র হরতাল ও সভার আয়োজন করে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস" পালন করে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ দিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। কলকাতায় ঐ দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। সভা আরম্ভ হবার আগে থেকেই কলকাতার স্থানে স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়। ইস্পাহানি লিখেছেন, তিনি সভার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় সাড়ে এগারোটায় সংবাদ পান যে, সার্কুলার রোডে ও করপোরেশন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে হিন্দুগণ রাস্তার দুই পাশে বাড়িগুলো থেকে মুসলমানদের মিছিলের ওপর পাথর ও বোতল নিক্ষেপ করে। বিকেল সাড়ে তিনটায় খবর আসে, ভবানীপুর এলাকায় শিখ ও হিন্দুগণ সেখানকার মুসলমান স্ত্রীলোক ও ছেলেমেয়েদের ওপর আক্রমণ করেছে। এ সময় আরও কয়েকটি এলাকা থেকে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের সংবাদ আসে। কলকাতায় দাঙ্গার জন্য ইস্পানি কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভাকে দায়ী করেন। অপরপক্ষে কংগ্রেস নেতাগণ দাঙ্গার জন্য বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও লীগ নেতাদের দায়ী করেন। কলকাতায় এ দাঙ্গার বিবরণ দিয়ে স্টিফেনস লিখেছেন, "শ্যাম পুকুর ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মানুষের মৃতদেহের স্তূপ নিকটবর্তী বাড়িগুলোর দোতালার মেঝ বরাবর উঁচু হয়ে উঠেছিল।" তবে এটা অতিরঞ্জিত। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর হিসেব মতে প্রায় ৫০,০০০ লোক হতাহত হয়েছিল।

এরূপ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা দেন, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের পূর্বেই ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিকট শাসনভার অর্পণ করবে। তিনি আরও ঘোষণা দেন, জুন মাসের মধ্যে সংবিধান পরিষদ সংবিধান রচনায় ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার নিজের ইচ্ছানুযায়ী ভারতের যেকোনো রাজনৈতিক দলের হস্তে কেন্দ্রের শাসন ভার অর্পণ করবে। এটাই এটলির ঘোষণা বা ফেব্রুয়ারি ঘোষণা নামে পরিচিত। এটলির ঘোষণায় ভারত বিভাগের ইঙ্গিত থাকায় মহাত্মা গান্ধী অনতিকালের মধ্যেই পূর্ণ ক্ষমতা বিনাশর্তে ভারতীয়দের হস্তে হস্তান্তরের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন।

এটলির ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লর্ড ওয়েভেল-এর স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর নিযুক্ত করা হয় (২৪ মার্চ, ১৯৪৬)। মাউন্টব্যাটেন ভি. পি. মেননের সহযোগিতায় তৎকালীন ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত বিভাগের একটি বাস্তব ও সর্বসম্মত পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন এ পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। এটাই ইতিহাসে ৩ জুনের পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার নিম্নবর্ণিত প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরা হয়:

১। এই পরিকল্পনায় ভারত ও পাকিস্তান নামে ২টি ডোমিনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

২। ভারত বিভক্তির নিম্নবর্ণিত রূপরেখা দেওয়া হয়:

(ক) পাঞ্জাব ও বাংলা প্রাদেশিক আইনসভার মুসলমান ও অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহের প্রতিনিধিগণ আলাদাভাবে ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবে।

(খ) সিন্ধু প্রদেশের যোগদানের সিদ্ধান্ত সিন্ধু প্রাদেশিক আইনসভার ওপর দেওয়া হয়।

(গ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে যেকোনো ডোমিনিয়নে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেবে।

(ঘ) বেলুচিস্তানের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্মিলিতভাবে ভারতে বা পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেবে।

৩। বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা কার্যকর করার জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়।

৪। প্রস্তাবিত দুটি রাষ্ট্রের গণপরিষদ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে থাকা না থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

৫। দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো ডোমিনিয়নে যোগদান করতে বা স্বাধীন থাকতে পারবে।

৬। ভারত ও পাকিস্তানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে একটি ভারতীয় স্বাধীনতা বিল ব্রিটিশ আইন পরিষদে পেশ করা হবে।

এ পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করে। এই আইনের উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ ছিল-

১। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানের মধ্যে থাকবে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন গঠিত হয় (মুম্বাই, গুজরাট, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিম বাংলা, মাদ্রাজ, মধ্য প্রদেশ, আজমীর, কুর্গ এবং মুসলিম অধ্যুষিত শ্রীহট্ট ছাড়া আসাম)।

২। উভয় রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয় পরিচালনা করবে।

৩। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত একটি কমিশন দ্বারা স্থির করার ব্যবস্থা হয়।

৪। পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা তাও এদের ইচ্ছার অধীনে ছেড়ে দেওয়া হয়। সার্বভৌম গণপরিষদই এটা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করার অধিকারী হলো।

৫। এ আইনে ভারত সচিবের (Secretary of state for India) পদের অবসান ঘটে। ভারত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের সাথে সংযোগ রক্ষা করার জন্য কমনওয়েলথ সেক্রেটারির ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

৬। উভয় ডোমিনিয়নের গণপরিষদ স্বাধীনভাবে তাদের শাসনতন্ত্র রচনা করবে। যতদিন নতুন শাসনতন্ত্র রচিত না হবে ততদিন দু'দেশ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবে।

৭। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হতে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে। এই রাজ্যগুলোকে ভারতীয় ইউনিয়ন অথবা পাকিস্তানে যোগদান করার অথবা স্বাধীন থাকার অধিকার দেওয়া হয়। এ আইনের ফলে দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে ইংল্যান্ডের রাজার সকল সন্ধি বা চুক্তি বিলুপ্তি ঘটে।

৮। এ আইনের ফলে রাজকীয় মর্যাদা ও উপাধি হতে ভারত সম্রাট (Emperor of India) উপাধি বিলুপ্ত হয় এবং ভারতের শাসন সংক্রান্ত বিষয় হতে ব্রিটিশ সরকারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

৯। পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়নের জন্য সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার নিম্নলিখিত পরিবর্তন ও সংশোধনের পর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যথা:

ক. গভর্নর জেনারেল বা প্রাদেশিক গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা, বিচারবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা এবং বিশেষ দায়িত্ব প্রভৃতির অবসান ঘটবে এবং এখন হতে তাঁরা স্ব স্ব মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শমতো সকল অবস্থায় কার্য পরিচালনা করবেন।

খ. মন্ত্রিসভার পরামর্শমতো এখন হতে প্রত্যেক ডোমিনিয়নে গভর্নর জেনারেল ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।

গ. মন্ত্রিসভার পরামর্শমতো গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক গভর্নরকে নিযুক্ত করবেন।

ঘ. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইনের সাথে অসামঞ্জস্য এই অজুহাতে আইন পরিষদের কোনো আইন অচল এটা অপ্রচলিত হবে না।

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব (Importance of the Indian independence act of 1947)

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নিম্নে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:

১। রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান: ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানে এ আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৭৫৭ সাল থেকে ভারত উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা চলছিল এ আইনের দ্বারা তার নিরসন হয়।

২। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এ আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে সুদীর্ঘ ১৯০ বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বিনা রক্তপাতে এবং সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াই দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এ দিক থেকে বিচার করলে ১৯৪৭সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব অনেক।

৩। সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা: এ আইন দ্বারা গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা, বিশেষ ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা বিলুপ্ত করায় ভারত ও পাকিস্তানে সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। নতুন নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু করে এ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তাই ভারত ও পাকিস্তানে সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।

৪। নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা: এ আইন ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং জীবনযাত্রায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সুতরাং এ আইন ভারত ও পাকিস্তানে নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ