- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য
আইনের উৎসসমূহ | Sources of Law
আইন বিশেষজ্ঞ মহল বলে থাকেন, "Law has been made, it has grown also." "সমাজ বিকাশের ক্রমধারায় আইন গড়ে উঠেছে।" তবে Prof. Holland-এর মতে, আইন গড়ে ওঠার পশ্চাতে ছয়টি উৎস নিহিত রয়েছে। যথা:
(ক) প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি (Customs)
(খ) ধর্ম (Religion)
(গ) বিচারকের রায় (Adjudication)
(ঘ) বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা (Scientific commentaries)
(ঙ) ন্যায়বোধ (Equity)
(চ) আইনসভা (Legislature)
এছাড়াও আইনের আরও কয়েকটি উৎস রয়েছে। যেমন- জনমত, নির্বাহী আদেশ, আন্তর্জাতিক আইন, বৈদেশিক চুক্তি ও সংবিধান ইত্যাদি। নিম্নে রেখাচিত্রের সাহায্যে আইনের উৎসসমূহ দেখানো হলো:
নিম্নে উৎসগুলো সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো:
১. প্রচলিত প্রথা (Customs): সমাজে প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি আইনের প্রাচীন উৎসসমূহের মধ্যে অন্যতম। সমাজের অভ্যন্তরে সুদীর্ঘকাল প্রচলিত লোকাচার, দেশাচার এবং রীতিনীতিই হলো প্রথা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সেগুলো নীতিগতভাবেই মেনে চলত। ফলে প্রাচীন সমাজে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে প্রথানির্ভর। কালক্রমে ঐসব রীতিনীতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে আইনের মর্যাদা লাভ করে। যেমন- ব্রিটেনের সংবিধানের সিংহভাগ দখল করে আছে বিভিন্ন ধরনের দেশাচার। ব্রিটিশ জনগণ ঐসব দেশাচারকে শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলে। আমাদের দেশে মুসলিম আইন কিংবা হিন্দু সমাজে হিন্দু আইন প্রবর্তনের পশ্চাতে প্রথার প্রভাব বিদ্যমান।
২. ধর্ম (Religion): ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় অনুশাসন আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের একচেটিয়া প্রভাব বিদ্যমান ছিল এবং মানুষের জীবন অনেকটা ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতো। সেই সূত্র ধরে যুগে যুগে ধর্মীয় রীতিনীতি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। মধ্যযুগেও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যধিক। আর এরূপ প্রভাব বিস্তারের কারণেই হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান সমাজের অনেক আইনে ধর্মীয় বিধি-বিধানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ধর্মের বিধান মেনে চলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো কালক্রমে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
৩. বিচারকের রায় (Adjudication): আদিম সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গই যাবতীয় বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করতেন। পরবর্তীকালে রাজা-বাদশা, দলপতি বা জ্ঞানীজন এরূপ বিবাদ-মীমাংসায় এগিয়ে আসেন। প্রথাগত বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর অসম্পূর্ণতার দরুন রাজা-বাদশা বা দলপতিগণ অনেক সময় নিজস্ব বুদ্ধির ভিত্তিতে বিবাদের বিচার করতেন। পরবর্তীতে ঐসব বিচারের রায় আইন হিসেবে গণ্য হয়। বর্তমানকালেও কোনো কোনো জটিল মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ঐ প্রক্রিয়ায় বিচারের রায় প্রদান করা হয়। বিচারকগণ শুধু যে আইনের প্রয়োগ ঘটান তাই নয়; বরং তারা জটিল ও অস্পষ্ট আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন।
৪. বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা (Scientific commentaries): বিখ্যাত আইন বিশারদগণের ভাষ্য অনেক সময় আইনের সৃষ্টি করে। সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ তাদের বিবেক-বুদ্ধির আলোকে আইন তৈরি করেন যা পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়। আইনসংক্রান্ত এরূপ গ্রন্থাবলি আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। যেমন- মুসলিম আইনের ক্ষেত্রে 'হেদায়া' ও 'ফুতুহায়ে আলমগীরীর' অবদান অন্যতম। এছাড়া আইনজ্ঞ Cocke লিখিত 'Institute', Blackstone-এর 'Commentaties on the Laws of England', A. V. Dicey-এর Law of the Constitution গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিন্দুদের 'মনুশাস্ত্র' এবং মুসলমানদের 'ইমাম আবু হানিফা' প্রমুখ আইন বিশারদদের গ্রন্থাবলি যুগ যুগ ধরে আইনের উৎস হিসেবে কাজ করছে।
৫. ন্যায়বোধ (Equity): বিচারকদের দায়িত্ব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কোনো মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে বিচারক যদি লক্ষ করেন যে, মামলাটির জন্য প্রচলিত আইন প্রযোজ্য নয় তখন সততা, ন্যায় ও নীতিবোধের আলোকে নতুন আইন তৈরি করে মামলার রায় প্রদান করেন। পরবর্তীকালে অনুরূপ মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকগণ উক্ত রায় অনুসরণ করে থাকেন। সুতরাং ন্যায়বোধ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
৬. আইনসভা (Lagislature): আধুনিক সমাজে আইনসভাকে আইনের সর্বপ্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। আইনসভার সদস্যগণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং জনগণের অধিকার ও দাবির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে আইন তৈরি করেন। এছাড়া আইনসভা প্রচলিত আইনের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে পুরাতন আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং প্রয়োজনবোধে নতুন আইন তৈরি করেন।
৭. জনমত (Public opinion): আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতকে আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন পরিষদের সদস্যগণ সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এজন্য জনমতকে উপেক্ষা করে আইনসভাও আইন পাস করতে পারে না। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বা সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধনীর ব্যাপারে আইনসভা অনেক সময় জনমত যাচাইয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এজন্য ওপেনহাইম, হল প্রমুখ মনীষী জনমতকে আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বলে উল্লেখ করেন।
৮. নির্বাহী আদেশ (Executive decree): আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে নির্বাহী প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক বিভিন্ন আদেশ বা ডিক্রি জারি হয়ে থাকে। এসব আদেশকে ডিক্রি আইন বা প্রশাসনিক আইন বলে গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে এগুলো নতুন আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।
৯. আন্তর্জাতিক আইন (International law): অধুনা আন্তর্জাতিক আইনও আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সম্পর্ক স্থাপনে আন্তর্জাতিক আইন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কোনো রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়ন করতে পারে না।
১০. বৈদেশিক চুক্তি (Foreign treaty): নির্বাহী ক্ষমতা বলে সরকার বিভিন্ন দেশের সাথে যেসব বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদন করে তা পার্লামেন্ট তথা আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি কোনো রাষ্ট্রের সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদন করেন সে ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
১১. সংবিধান (Constitution): সংবিধান আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার বিধি-বিধান লিপিবদ্ধ থাকে। সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল নীতিমালা সংবলিত দলিল যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য। সংবিধানের আলোকেই পার্লামেন্ট তথা আইন সভা প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করে।
উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায়, আইন হলো ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে সুন্দর ও সুসংহত করার বিশেষ পদ্ধতি। আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব। আইন নিছক কোনো ধারণা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন উৎসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ