- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ | Safeguards of Liberty
স্বাধীনতা ভোগ করার চেয়ে স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা কঠিন কাজ। অর্থাৎ স্বাধীনতার সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়; যা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নামে পরিচিত। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা রক্ষার কতকগুলো রক্ষাকবচের উল্লেখ করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ-
১. আইন (Law): আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত (Law is the pre-condition of liberty)। আইনের উপস্থিতিতেই স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব হয়। আইনহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, জন লক (John Locke) বলেন, "যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।" (Where there is no law, there is no liberty)। আইনের যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা উপভোগ অর্থবহ হয়ে ওঠে।
২. মৌলিক অধিকার (Written fundamental rights): স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধকরণ। কারণ মৌলিক অধিকার উপভোগের সুযোগ ব্যতীত নাগরিক জীবন পূর্ণতা পায় না। তাই সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হলে নাগরিকেরা তদসম্পর্কে সচেতন থাকে। মৌলিক অধিকার ভঙ্গের কারণে ভিকটিম সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে।
৩. আইনের শাসন (Rule of law): আইনের শাসন স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। আইনের শাসনের অর্থ মূলত (ক) আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান (খ) বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এবং (গ) বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা যাবে না। আইনের শাসন বলতে আইনের পরিপূর্ণ প্রাধান্যকেই নির্দেশ করে- যেখানে শাসকমহল আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কোনো কিছু করতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অতি নগণ্য ব্যক্তিটিও একই আইনের অধীন।
৪. গণতন্ত্র (Democracy): গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকার উপভোগের সর্বাধিক সুযোগ থাকে। গণতন্ত্র বলতে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণের পক্ষে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে সকলের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা করা হয়। গণতন্ত্রের মূল শ্লোগান "জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।" শাসকগোষ্ঠী জনগণের ভোটাধিকার লাভ করে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। এরূপ সরকার সাধারণত জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করে না। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্ভাব্য জনমত যাচাই করা হয়। এতে জনমত (Public opinion)-এর প্রতিফলন ঘটে।
৫. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of power): ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ স্বাধীনতা সংরক্ষণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। এ নীতির মূলকথা হলো সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে অহেতুক হস্তক্ষেপ করবে না বা প্রভাব বিস্তার করবে না। কারণ একই ব্যক্তির হাতে একাধিক বিভাগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে স্বৈরশাসনের সৃষ্টি হয়।
৬. সদাসতর্ক জনমত (Eternal public vigilance): আধুনিককালে স্বাধীনতার বলিষ্ঠ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হলো সদাসতর্ক জনমত। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. H. J. Laski) বলেন, "চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল্য নিহিত।" ("Eternal vigilance is the price of liberty.") নাগরিকদের উচিত স্বাধীনতা বিঘ্নকারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং চরম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা। এ প্রসঙ্গে হেনরি নেভিনশন যথার্থই বলেন, "স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনোদিন শেষ হয় না কিংবা এর সংগ্রামক্ষেত্র কোনোদিন নীরব হয় না।"
৭. স্বাধীন বিচার বিভাগ (Independent Judiciary): স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকার রক্ষার অন্যতম রক্ষাকবচ। ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ থাকলে কোনো নাগরিকের অধিকার ভঙ্গ হলে সর্বোচ্চ আদালত তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে পারে এবং সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অধিকতর ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে।
৮. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা (Responsible Government): স্বাধীন Government): স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণের সরকারকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীলতা দুভাবে নিশ্চিত করা যায়। এক. জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা গঠিত আইনসভা জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকবে। দুই, নির্বাচিত আইনসভার সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা বা শাসন বিভাগ তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আইনসভার কাছে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। এরূপ দায়িত্বশীলতা বা জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা থাকলে নাগরিকের স্বাধীনতা অধিকতর রক্ষা পাবে।
৯. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralisation of Power): স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। কারণ একটিমাত্র কেন্দ্রের হাতে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে একদিকে শাসনব্যবস্থায় স্থবিরতা আসে এবং অন্যদিকে শাসক স্বৈরাচারিতার পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতার অবাধ প্রবাহ প্রয়োজন।
১০. সরকার ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতা (Co-operation between Government and people): সরকার ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচ্য। কারণ বিরোধিতা শুধু ধ্বংস ডেকে আনে। আর বিপরীতে মধুর সম্পর্কের সমৃদ্ধি বয়ে আনে। এজন্য সরকার যদি জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং জনগণ যদি সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাহলে স্বাধীনতা রক্ষিত হবে।
১১. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি (Direct democratic system): গণ ভোট, গণ উদ্যোগ, পদচ্যুতির মতো প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগ করে জনগণ শাসকদের স্বৈরাচারী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করে নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে। এভাবে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং শাসকবর্গ জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট থাকে।
১২. বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ (Abolition of special facilities): অনেক সময় রাষ্ট্রের মধ্যে সরকারের যোগসাজশে বিশেষ মহলের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। এতে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। সুতরাং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এরূপ সুযোগ-সুবিধা বিলোপ করতে হবে।
১৩. সামাজিক ন্যায়বিচার (Social justice): সামাজিক ন্যায়বিচার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত। সামাজিক ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল মানুষের সমানভাবে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার বা পরিবেশ নিশ্চিত করা। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
১৪ . অর্থনৈতিক সাম্য (Economic equality): স্বাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সমাজের সকল মানুষের জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই হলো অর্থনৈতিক সাম্য। অর্থনৈতিক অসমতা বা সাম্যের অভাব সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়ে যায়। ফলে গরিব বা সম্পদহীন মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খুবই প্রয়োজন।
১৫. প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা (Freedom of press): সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ প্রচার মাধ্যসমূহ জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে সমাজে প্রচার মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়, সেখানে স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাই স্বাধীনতা রক্ষায় প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা আবশ্যক।
১৬. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল (Organized political party): সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে সরকারকে সতর্ক করে দেয়। এভাবে বিরোধীদলসমূহ স্বাধীনতা রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরীর মতো কাজ করে।
১৭. শোষণমুক্ত সামাজিক কাঠামো (Exploitation free social structure): আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ অবসানের কথা বলেন। সমাজের এক শ্রেণি কর্তৃক যাতে অন্যকোনো শ্রেণি শোষণ, বঞ্চনার শিকার না হয় সেজন্য তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। আর এজন্য প্রয়োজন শোষণমুক্ত সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা। এভাবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা সম্ভব।
উপরের বিস্তৃত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যদিও স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার তথাপি স্বাধীনতা বিনাশ্রমে উপভোগ করা যায় না। স্বাধীনতার স্বাদ পরিপূর্ণরূপে পেতে হলে উপর্যুক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ আবশ্যক। অন্যথায় স্বাধীনতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ