• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য

আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক | Relation Between Law and Morality

আইন ও নৈতিকতা এক বিষয় না হলেও উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আইন চিরাচরিত প্রথা, ধর্মীয় অনুশাসন, বিচারকদের রায় ও আইনসংক্রান্ত গ্রন্থাবলির সমন্বয়ে সৃষ্টি। আর নৈতিকতা একান্তভাবেই মানুষের মন থেকে উৎপত্তি লাভকরে। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থেকে নৈতিকতার বিকাশ ঘটে। নৈতিকতা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত ধ্যান-ধারণার সমষ্টি যা মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে বিকশিত করে তোলে। উভয়ের সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে আইন ও নৈতিকতার মধ্যকার সাদৃশ্য বা সম্পর্ক আলোচনা করা হলো:

১. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগত সম্পর্ক: উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের উদ্দেশ্য ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গল বিধান করা। আইন সমাজের সুনাগরিক সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথকে সুগম করে শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি মানব চরিত্রের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে উন্নত ও আদর্শ জীবন নিশ্চিত করা নৈতিকতার লক্ষ্য। প্লেটো তাঁর বিখ্যাত "The Laws' গ্রন্থে বলেন, "আইনহীন জীবন ও পশুর জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।" উভয়ের সংমিশ্রণে ভালো মানুষ ও ভালো দেশ গঠন সম্ভব।

২. ব্যুৎপত্তিগত সম্পর্ক উৎসগত দিক থেকেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রথাগত বিধান, ধর্ম প্রভৃতি আইন ও নৈতিকতার উৎস। সামাজিক মূল্যবোধ (Social values) ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকেই প্রচলিত নীতিবোধের জন্ম। আইন ও নৈতিকতাবোধের সমন্বিত আহ্বানেই সামাজিক বিধি-বিধানের সোপান নির্মিত হয়েছে। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতির অর্থ আইন ব্যবস্থার উন্নতি। কেননা, মানুষের নীতিবোধকে উপেক্ষা করে কোনো আইন তৈরি হতে পারে না। যৌক্তিক আইন একটি দেশের নৈতিক মানের পরিচায়ক।

৩. বিষয়বস্তুগত সম্পর্ক: আইন ও নৈতিকতার আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ ও সমাজ। সমাজবদ্ধ মানুষের নানা দিক নিয়ে আইন ও নৈতিকতা আলোচনা করে। মানুষের ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি বিষয় আইন ও নৈতিকতার আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রীয় সংগঠনের অনুপস্থিতিতে কতকগুলো নৈতিক বিধানের সাহায্যে সামাজিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। অর্থাৎ মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার মধ্যে আইন ও নৈতিকতার সহাবস্থান।

৪. একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মত পোষণ করেন যে, আইন নৈতিক বিধানের ওপর ভিত্তিশীল। অধ্যাপক গেটেল (Prof. R. G. Gettell) বলেন, প্রচলিত ন্যায়-নীতির ধারণা নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে এবং এটাই স্বচ্ছ স্ফটিকের ন্যায় আইনশাস্ত্রে সঞ্চিত হয়। নৈতিকতার সংমিশ্রণে প্রণীত না হলে কোনো আইন স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য লাভ করতে পারে না।

৫. একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আইন ও নৈতিক বিধান একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যে কাজ আইনসম্মত নয় তা নীতিবিরুদ্ধও বটে। যেমন- পূর্বে হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথা রীতিসম্মত ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা দণ্ডনীয় ও রীতিবিরুদ্ধ।

৬. পরিবর্তনশীলতা সামাজিক পরিবর্তনের সাথে আইন ও নৈতিকতারও পরিবর্তন ঘটে। নতুন আইন প্রবর্তনের ফলে নৈতিকতার মানদণ্ডও পরিবর্তিত হয়। যেমন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আইনে নৈতিকতার মানদণ্ড একরকম, তেমন সমাজতান্ত্রিক শাসনে নৈতিকতার মানদণ্ড অনেকটা অন্যরকমের। কেননা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইনকানুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে অনেকাংশে ভিন্ন রকমের।

৭. মানুষের কল্যাণ সাধন আইন ও নৈতিকতা উভয়ে সমাজবদ্ধ মানুষের কল্যাণ সাধন করে। মানুষের যা অকল্যাণকর আইন ও নৈতিকতা সে পথ পরিহার করার শিক্ষা দেয়। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকের কল্যাণ সাধন করে। আর নৈতিকতা মানুষের মনোজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করে।

৮. সফলতার দিক থেকে সাফল্যের দিক থেকে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আইনের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে নীতিবোধের ওপর। আইন সামাজিক নীতিবিরোধের আলোকে প্রণীত হলে তা সহজেই জনগণের নিকট স্বীকৃতি পায় এবং কার্যকর হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, আইন মনুষ্য সমাজ তার প্রয়োজনে তৈরি করে, যাতে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করে। আর নৈতিকতা হলো আধ্যাত্মিক বিষয় যা দ্বারা সমাজ ও ব্যক্তিজীবনকে আরও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যায়।

আইন ও নৈতিকতার মধ্যে উপরিউক্ত অনেক সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকলেও উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তা নিম্নরূপ:

১. পরিধিগত পার্থক্য নৈতিকতার পরিধি আইনের তুলনায় বেশ ব্যাপক। আইন কেবলমাত্র মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নৈতিকতা বাহ্যিক ও মানসিক উভয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

২. মেনে চলার ক্ষেত্রে পার্থক্য আইন মেনে চলা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু নৈতিকতা মেনে চলা ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। নৈতিকতা মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়।

৩. অনুমোদনের ক্ষেত্রে আইন সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং এর পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অনুমোদন থাকে। কিন্তু নৈতিকতার পেছনে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিকতার স্বীকৃতি রয়েছে।

৪. শাস্তি প্রাপ্তির দিক থেকে আইন ভঙ্গ করলে মানুষকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু নৈতিকতা ভঙ্গ করলে কোনো শাস্তি পেতে হয় না। তবে সামাজিক নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়।

৫. সুস্পষ্টতার দিক থেকে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত হয় বলে আইন অনেকটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। নৈতিকতা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত নয় বলে তা অনির্দিষ্ট ও সামাজিক রীতিনীতি নির্ভর।

৬. বিভিন্নতার ক্ষেত্রে: নৈতিক বিধানসমূহ সব দেশে সর্বকালেই প্রচলিত। মানুষ ইচ্ছে করলে রাতারাতি একে পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু আইন সময়-প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। মানুষ প্রয়োজনবোধে তা সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। 

৭. ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নে: ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নীতিগতভাবে যা অন্যায়, আইনের চোখে তা নাও হতে পারে। যেমন- মদপান নীতি বিরুদ্ধ কিন্তু সবসময় বেআইনী নয়। আবার যা আইনের চোখে দণ্ডনীয়, নৈতিক বিচারে তা দোষের নাও হতে পারে।

৮. প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইন সর্বজনীন এবং তা সমাজের সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। অন্যদিকে, নৈতিকতার প্রয়োগের বিষয়টি ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিভেদে মানুষের নৈতিকতা মানা, না মানার বিষয়টির তারতম্য হয়ে থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে যদিও কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তবুও উভয়ের মধ্যে অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। কেননা আইন ও নৈতিকতা একে অপরের সাহায্য ও সহযোগিতা করে থকে। তাই এরা একে অপরের পরিপূরক।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ