• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম

মুক্তিবাহিনী গঠন (স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী)

২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যার শুরু থেকেই বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন, প্রাক্তন ইপিআর, পুলিশ, আনসার কোথাও কোথাও ছাত্র-জনতা বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত এবং অপরিকল্পিতভাবে। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। অন্তর্ভুক্ত করা হয় নিয়মিত বাহিনী এবং ক্রমান্বয়ে গড়ে তোলা হয় সেক্টর, ফোর্স, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী। পাশাপাশি স্থানীয় প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে অনিয়মিত বাহিনী, বেসামরিক বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। মোটকথা সর্বস্তরের মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল মুক্তিবাহিনী। যে যার যার অবস্থান থেকে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

১৮ এপ্রিল এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে নিম্নলিখিত বাহিনীসমূহ গঠন করা হয়:

১। নিয়মিত বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীতে দক্ষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮,৬০০ জন। এদেরকে সামরিক বেতন ভাতা দেওয়া হতো। এ বাহিনীতে ৩টি ফোর্স গঠন করা হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে 'জেড' ফোর্স, লে. কর্নেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল ও ৩ নম্বর সেক্টর নিয়ে 'এস' ফোর্স এবং লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে 'কে' ফোর্স গঠিত হয়। নিয়মিত বাহিনী হিসেবে স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

(ক) স্থল বা সেনাবাহিনী: মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ৬১ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয় লেফটেনেন্ট পদে কমিশন দিয়ে সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু করেন। এ সকল অফিসাররা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সেক্টরে যোগ দিলে যুদ্ধে গতি সঞ্চার হয়।

(খ) নৌবাহিনী: ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে নৌবাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার আগস্ট মাসের শেষে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশ্যে কলকাতা পোর্ট কমিশন থেকে এম.ভি পদ্মা ও এম.ভি পলাশ নামে দুটি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। ৩৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জাহাজ দুটিকে নৌযুদ্ধের উপযোগী করা হয়। নভেম্বর মাসে ৪৫ জন পালিয়ে আসা নৌ-সেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর গোড়াপত্তন করা হয়। এম.ভি পদ্মা ও এম.ভি পলাশসহ পাকিস্তান বাহিনীর নিকট থেকে দখলকৃত ৬টি নৌ-যান নিয়ে নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। নভেম্বর পর্যন্ত ৮৬০ জন নৌ-কমান্ডারকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরা অনেক সফল অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি রসদ বহনকারী জাহাজ এম.ভি আল-আকাস ও এম.ভি হরমুজসহ অনেক জাহাজ, ট্যাংক ডুবিয়ে দেয়।

(গ) বিমানবাহিনী গঠন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের তেজগাঁও এয়ারবেসের ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকারের নেতৃত্বে ১৮ জন দক্ষ পাইলট (একাত্তরের মার্চ মাসে যে সকল বাঙালি পাইলট অফিসার বাৎসরিক ছুটিতে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল) এবং ৫০ জন টেকনিশিয়ান ও একজন কুকার নিয়ে বিমানবাহিনী গঠিত হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে বৈমানিক সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন এবং সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছিলেন সেই ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানকে কড়া প্রহরায় পরিবারসহ করাচিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগস্ট ইন্সট্রাক্টর হিসেবে একটি জঙ্গী বিমানে জনৈক অবাঙালি ক্যাডেটকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় অত্যন্ত দুঃসাহসিক দক্ষতা প্রদর্শন করে রাডারের দৃষ্টি এড়িয়ে সীমান্ত অতিক্রমের প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু উক্ত ক্যাডেট পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তাকে বাধা দেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারত সীমানায় মাত্র কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে ফ্লাইট বিমানটি বিধ্বস্ত হলে উভয়ে নিহত হন। এই বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনিই হচ্ছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ। এ দিকে ক্যাপ্টেন খন্দকারের নেতৃত্বে বাকি ১৭ জন বৈমানিক এবং ৫০ জন টেকনিশিয়ান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মুজিবনগর সরকারের নিকট রিপোর্ট করেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এদের গোপন প্রশিক্ষণ প্রদান, রানওয়ে এবং প্রয়োজনীয় বিমানের অভাব দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে বৈমানিকরা আপাতত স্থলবাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে বিমান বাহিনীর আরও কতিপয় অফিসার মুজিবনগরে হাজির হন। এরা হচ্ছেন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট এম কাদের, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট জামাল উদ্দীন, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট সার্জেন্ট ফজলুল হক, ক্যাডেট অফিসার এম.এ কুদ্দুস এবং ক্যাডেট অফিসার এম. মাহমুদ প্রমুখ। মাত্র ৮ সপ্তাহকাল দুরূহ প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দুর্জয় শপথ নিয়ে তৈরি হলো বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। তখন তাদের কাছে ছিল মুজিবনগর সরকারের সংগ্রহ করা একটি অটার প্লেন, একটি ডাকোটা বিমান এবং একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর 'বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত' এই স্লোগান হৃদয়ে ধারণ করে সর্বপ্রথম বাংলার বিমান বাংলার আকাশে উড্ডীন হলো। হামলার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বেছে নিল- (১) চট্টগ্রাম বন্দর (২) চট্টগ্রাম তেল শোধনাগার (৩) ভৈরব বাজার এবং (৪) নারায়ণগঞ্জ বন্দর। কয়েক দফা হামলা করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে।

২। অনিয়মিত বা ফ্রিডম ফাইটার্স (এফ. এফ) বাহিনী: নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও অনিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়; যারা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের দিশেহারা করে ফেলে। অনিয়মিত বাহিনী গঠিত হয় ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক নিয়ে। এ বাহিনীর সদস্যদের দু'সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন কমান্ডারের অধীনে তাদের নিজ নিজ এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করা হতো। এ বাহিনীর জন্য কোনো সামরিক আইন কার্যকর ছিল না। তাদের কোনো বেতন ভাতাও দেওয়া হতো না। অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার।

৩। স্বাধীন বাহিনী: নিয়মিত-অনিয়মিত বাহিনী ছাড়াও সম্পূর্ণ স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে দেশের বাইরে এবং দেশের অভ্যন্তরেই বেশ কিছু বাহিনী গড়ে উঠেছিল; যারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তাদের অবদান অপরিসীম। এ সকল বাহিনীর মধ্যে ছিল-

(ক) মুজিব বাহিনী: মুজিব বাহিনীর জন্ম ভারতে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বাছাই করা শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে এ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশ সরকার এবং সেক্টর কমান্ডারের অজান্তে দেরাদুন ও আসামের জাফলং-এ এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেশে প্রবেশ করে এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

(খ) আফসারী বাহিনী ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার মল্লিক বাড়ি গ্রামে একটিমাত্র রাইফেল নিয়ে মেজর আফসার উদ্দীন এ বাহিনী গড়ে তোলেন। তার এ বাহিনীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভালুকা থানায় পাকবাহিনীর সঙ্গে একটানা ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধ করে এ বাহিনী কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

(গ) হেমায়েত বাহিনী দ্বিতীয় ইস্ট রেজিমেন্টের হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিন ২৯ মে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার বাটারা বাজারে এ বাহিনীর উদ্বোধন করেন। এ বাহিনী জুন মাসের মধ্যে ফরিদপুর ও বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫,০৫০ জন। হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়েই এরা যুদ্ধ করে। মোট ১৮টি সফল আক্রমণ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

(ঘ) কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর (বাঘা সিদ্দিকী নামেও পরিচিত) নেতৃত্বে এ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনী ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। এ বাহিনীর নাম শোনলেই পাকবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরত। কাদেরিয়া বাহিনী ৩০০-এর অধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সহস্রাধিক পাক সৈন্য খতম করে। টাঙ্গাইল ও এর আশেপাশের প্রায় ১৫,০০০ বর্গমাইল এলাকা কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ