- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের কর্মতৎপরতা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর করাল গ্রাস থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্তি করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজি রেখে যখন প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলার কতিপয় কুলাঙ্গার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে হাত মেলায়। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করতে না পারে, দেশ যাতে পরাধীন থাকে। সেজন্য তারা পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু করে। পাকিস্তান অখণ্ডতা রক্ষা ও ইসলামের নামে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে গণহত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশব্যাপী এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পথ চিনিয়ে নেওয়া, অতি গোপনে মুক্তিবাহিনীর তথ্য দেওয়া ও মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণিত কাজ তারা করত। কিন্তু তাদের এ হীন উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারে না।
শান্তি কমিটি
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় সর্বপ্রথম যে সংগঠনটির জন্ম হয় তা হলো 'শান্তি কমিটি'। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জামায়াতে ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ওলামায়ে ইসলাম প্রভৃতি দলের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতায় এই "শান্তি কমিটি" গঠিত হয় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ঢাকা মহানগরীর কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খায়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা জেলা 'শান্তি কমিটি' গঠন করা হয়। এই কমিটি সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থেকে দেশ যাতে স্বাধীন হতে না পারে সেজন্য সকল অপতৎপরতা চালায় এবং দখলদার বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে মুক্তিবাহিনী ও তার পরিবার নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। এসব বাহিনী সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
রাজাকার বাহিনী
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কজনক অধ্যায় হলো রাজাকার বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে লে. জে. টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে কুখ্যাত "রাজাকার বাহিনী" গঠন করে। পাকিস্তানপন্থী ও স্বাধীনতা বিরোধীরা এই বাহিনীতে যোগদান করে। এরা পাক হানাদার বাহিনীর সাহায্যকারী বা দোসর হিসেবে কার্যরত ছিল।
রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান সরকার। শুরুতে আনসার মুজাহিদদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। পরে পাকিস্তানপন্থী অনেকে এই বাহিনীতে যোগ দেয়। এই বাহিনী গঠনে জেনারেল নিয়াজীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইসলামি ছাত্রসংঘের প্রধান মো: ইউসুফ রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে এদের বেতনের ব্যবস্থা ছিল। রিক্রুটের পর এই বাহিনীর সদস্যদের দেড় থেকে দুই সপ্তাহ মেয়াদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। তাদের প্রশিক্ষক ছিলেন পাক সেনাবাহিনীর জোয়ানরা। বন্দুকে গুলি ভর্তি করে টার্গেট স্থানে গুলি নিক্ষেপ পর্যন্ত তাদের প্রশিক্ষণ সীমাবদ্ধ ছিল। ট্রেনিং শেষে রাজাকার সদস্যকে ৩০৩ রাইফেল দেওয়া হতো। দখলদারবাহিনীর দোসর ও আজ্ঞাবহ হিসেবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এদের অন্যতম কাজ ছিল যেমন- মুক্তিযোদ্ধাদের অনুসন্ধান দেওয়া, হানাদারবাহিনীকে তাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেওয়া, গ্রাম থেকে গরু, ছাগল, মুরগি ধরে এনে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করা, গ্রাম থেকে যুবতী নারী ধরে এনে আর্মি ক্যাম্পে সরবরাহ করা ইত্যাদি। সে সময়ে কোনো পাকিস্তানপন্থী তার ব্যক্তিগত বা বংশীয় শত্রুকে নিধন করার কাজেও রাজাকার বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। ঐসব পাকিস্তানি দালালরা রাজাকারকে দিয়ে তার প্রতিপক্ষকে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে বন্দী করে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। প্রভাবশালী স্থানীয় দালালরা রাজাকার দিয়ে ভারতগামী শরণার্থীদের সর্বস্ব লুট করিয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া যায়। এভাবে দেখা যায় যে, সকল অপকর্মের সঙ্গে রাজাকারদের নাম জড়িয়ে পড়ে।
আলবদর বাহিনী
রাজাকারবাহিনী গঠনের পর আল বদরবাহিনী গঠিত হয়। তবে রাজাকার অধ্যাদেশের মতো এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর উদ্যোগে ও প্রেরণায় এই বাহিনী গঠিত হয়।
জামায়াতে ইসলামির ছাত্রসংগঠন ও ইসলামি ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয় (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বদরের যুদ্ধের স্মরণে এর নামকরণ)। আল বদরদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত পাকিস্তানবাহিনী। আলবদর বাহিনী স্বাধীনতার আন্দোলন নস্যাৎ করতে যেমন সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছে তেমনি বিরুদ্ধ শক্তিদের মুক্তিবাহিনী আখ্যা দিয়ে হত্যা কিংবা গুম করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য অনুসন্ধান, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গোপন সংবাদ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে এ বাহিনী নিয়োজিত ছিল। বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান দায়িত্ব ছিল আলবদর বাহিনীর ওপর। তাই এই বাহিনী ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হিংস্র প্রকৃতির।
আলশামস বাহিনী
স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য আর একটি বাহিনীর বিষয়ে জানা যায়। সেটি হলো আলশামস বাহিনী। ইসলামি ছাত্রসংঘের নেতাকর্মী ও প্রধানত অবাঙালি (বিহারিদের) নিয়ে এ বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর এই দোসরদের কাজ ছিল দেশের অভ্যন্তরে বাঙালি ভাবধারার সমর্থক ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকশ্রেণিকে হত্যা করা। এরা কখনো সহযোদ্ধা, কখনো বা বার্তাবাহক হিসেবে নানাভাবে স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকেছে।
বিহারি সম্প্রদায়
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এদেশে বসবাসরত বিহারি সম্প্রদায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন করে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর এদেশে আগত বিহারি সম্প্রদায় সব সময় কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী এদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় এবং বাঙালি নিধনে দেয় অবাধ অধিকার। বাঙালিদের সম্পদ লুট করতে এদেরকে উৎসাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে বিহারি সম্প্রদায় যে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা অকল্পনীয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এদেশে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালায়। তারা বাঙালি মুসলমানকে নিম্নজাতের বলে গণ্য করতো এবং তাদের হত্যাকাণ্ডকে পাপ জ্ঞান করত না। তারা পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পুরোপুরি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিতভাবে প্রতিটি সম্ভাবনাময় ছাত্র, প্রকৌশলী, ডাক্তার বা নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদের হত্যা করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী 'পোড়ামাটি নীতি' অনুযায়ী বাংলাদেশের সব সম্পদ ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। যে কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির কোনোকিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এভাবে মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানি দস্যুবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারি, আলশামস, আলবদর ও রাজাকার বাহিনী প্রায় ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

