• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন বা যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন United Front Election or the General Election of 1954

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। বাংলাদেশের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসকচক্রের নেতা মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেন। মুসলিম লীগের সীমাহীন রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পূর্ব বাংলার প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই নির্বাচনকে মোকাবিলা করার জন্য তার ৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আতাহার আলী এবং হাজী দানেশের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং বামপন্থি গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এছাড়া খেলাফতে রাব্বানী ও স্বতন্ত্র দল ভিন্ন ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয়। এই জোটের প্রতীক ছিল 'নৌকা' এবং ম্যানিফেস্টো ছিল ঐতিহাসিক ২১ দফা বাস্তবায়ন। এ দফাগুলো হলো-

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি

১। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

২। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টনের ব্যবস্থা।

৩। পাটশিল্প জাতীয়করণ করা।

৪। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

৫। লবণের কারখানা স্থাপন করা।

৬। মোহাজের-শিল্পী-কারিগর শ্রেণির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

৭। খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের অবসান করা।

৮। শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা।

৯। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা।

১০। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করা এবং সকল বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্য করা।

১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।

১২। শাসন ব্যয় হ্রাস করা। মন্ত্রীর বেতন এক হাজারের বেশি না হওয়া।

১৩। ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১৪। জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ করা।

১৫। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা।

১৬। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণাগারে পরিণত করা।

১৭। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ করা।

১৮। ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা।

১৯। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা।

২০। আইন পরিষদের মেয়াদ কোনোভাবেই বৃদ্ধি না করা।

২১। আইন পরিষদের আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন দিয়ে তা পূরণ করা।

২১ দফাকে সামনে রেখে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুক্তফ্রন্ট জয়লাভকরে। ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ৯টি, পাকিস্তানি জাতীয় কংগ্রেস ২৪টি, তফসিলি ফেডারেশন ২৭টি, অন্যান্য দল বাকি আসনগুলো লাভ করে। দেশ-বিদেশের পত্রিকায় একে 'ব্যালট বিপ্লব' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে ৩ এপ্রিল এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে।

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিপরিষদ

১। এ. কে. ফজলুল হক- মুখ্য, স্বরাষ্ট্র, সাহায্য ও পুনর্বাসন; স্বায়ত্তশাসন; শাসনতন্ত্র; নির্বাচন ও পার্লামেন্টারি বিষয়াদি; নিয়োগ, বদলি ও সাধারণ শাখা।

২। আতাউর রহমান খান- বেসামরিক সরবরাহ।

৩। আবু হেনা সরকার- অর্থ।

৪। কফিলউদ্দিন চৌধুরী- বিচার ও আইন।

৫। আবুল মনসুর আহমদ- জনস্বাস্থ্য।

৬। সৈয়দ আজিজুল হক- শিক্ষা ও রেজিস্ট্রার।

৭। আবদুস সালাম খান- শিল্প ও শ্রম।

৮। শেখ মুজিবুর রহমান- কৃষিঋণ, সমবায় ও পল্লিউন্নয়ন।

৯। আবদুল লতিফ বিশ্বাস- রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার।

১০। মুয়াজ্জেম উদ্দীন হুসাইন- স্টেট একুইজিশন।

১১। হামিদ উদ্দিন- বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন।

১২। ইউসুফ আলী চৌধুরী- কৃষি, বন ও পাট।

১৩। রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী- মেডিকেল ও জেল।

১৪। আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী - সড়ক ও গৃহ নির্মাণ।

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আত্মপ্রকাশে শঙ্কিত হয়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পতন ঘটানোর জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদেরই সৃষ্ট ষড়যন্ত্রে আদমজী পাটকল ও চন্দ্রঘোনায় শ্রমিক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত ঘটিয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ব্যর্থতা দেখানো হয়। যে কারণে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মাদ (খাজা নাজিম উদ্দীনের পর ১৫ অক্টোবর, ১৯৫১ দায়িত্ব প্রাপ্ত) যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ 'ক' ধারা জারি করেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক গৃহবন্দি হন এবং জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান , সহ ৩০০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনার অল্পদিনের মধ্যে স্বৈরাচারী গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মাদ ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর সার্বভৌম গণপরিষদ বাতিল করে সারা দেশে প্রথম বারের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। গোলাম মোহাম্মাদ অসুস্থতার অজুহাতে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ অক্টোবর পদত্যাগ করলে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। কিছু দিন পর তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থনে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। সেনাবাহিনী ছিল তার ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার হস্তক্ষেপের ফলেই ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব দেন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ ঘটনার মাত্র ৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রে মন্ত্রিসভার রদবদল হয়। ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। রিপাবলিকান পার্টির ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় পরিষদের আহ্বান ছাড়াই সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি পদত্যাগ করেন।

পূর্ববর্তী

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ