• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬)

মজলুম জননেতা নামে খ্যাত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ শরাফত আলী খান একজন নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক। মাতা মজিরন বিবি। তার বাল্য নাম চেকা মিয়া। বাল্যকালে তিনি ইরাক থেকে আগত পীর সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদীর নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং তার পরামর্শে তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে শিক্ষালাভের সময় তিনি দেশপ্রেমের দীক্ষা পান।

টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তৎকালীন জমিদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গুপ্তের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেন। এ সময় তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। জমিদার বিরোধী আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে জন্মভূমি সিরাজগঞ্জ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলে যান আসামে। সেখানে গিয়েও তিনি নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে আসামের ধুবড়ি জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে আয়োজিত বিশাল জনসভায় চরের বাঙালি কৃষক জনতা তাকে 'ভাসানী' উপাধিতে ভূষিত করে। সেই থেকে তিনি হলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মজলুমদের প্রতি যেখানেই জুলুম হয়েছে সেখানেই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন। সে কারণেই তাকে মজলুম জননেতা বলা হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি আসামে আট বছর জেল খাটেন।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দেন। একই বছর আসামে বাঙালি নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে 'লাইনপ্রথা' চালু হলে এই প্রথা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন (২২ ও ২৩ মার্চ, ১৯৪০)। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। তিনি হন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৪৯-১৯৫৭) এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হন যুগ্ম সম্পাদক। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নিকট তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী মানুষ। ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বিরুদ্ধে ভূখা মিছিলের নেতৃত্ব দিলে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলে তিনি আবারও কারারুদ্ধ হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব সাফল্যে তার অবদান অপরিসীম।

মাওলানা ভাসানী তার দূরদর্শিতা দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের হাত থেকে বাঙালিদের বাঁচা সম্ভব নয়। তাই তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দেই পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী "পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি" বাতিলের দাবি জানান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়াদী সে দাবি প্রত্যাখ্যান করলে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন (১৮ মার্চ, ১৯৫৭)। একই বছর তার নেতৃত্বে ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে "ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি" (ন্যাপ) গঠিত হয় এবং তিনি হন এর সভাপতি। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি চীনের বিপ্লব দিবস (১ অক্টোবর)-এর উৎসবে যোগদানের জন্য পিকিং যাত্রা করেন। সেখানে ৭ সপ্তাহ অবস্থানকালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে তখন স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে তার অবদান অপরিসীম। তিনি ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর দেশব্যাপী 'প্রতিরোধ দিবস' এবং ৭ ডিসেম্বর হরতালের আহ্বান করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনের তীব্রতায় ২২ মার্চ আগরতলার মামলা প্রত্যাহার এবং ২৫ মার্চ স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বিভিন্ন জনসভায় তিনি বলেছিলেন, 'স্বাধীন বাংলাদেশ না দেখে তিনি মরবেন না।' এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে তিনি ওয়ালাইকুম সালাম বলে চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতার কথা জানিয়ে দেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-এর ২২ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রবর্তন করেন এবং পত্রিকা প্রকাশ (সাপ্তাহিক হক কথা), বিভিন্ন সভা সমিতিতে আত্মত্মনিয়োগ করেন। তিনি দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে তাঁর অবদান স্মরণীয়। রাজনীতির পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি স্মরণীয়। তিনি "দেশের সমস্যা ও সমাধান" (১৯৬২) এবং "মাও সেতুং-এর দেশ" নামে দুইখানা গ্রন্থ রচনা করেন। গোটা বাঙালিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তার মহা প্রস্থানে বাংলার রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তার প্রতিষ্ঠিত টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে চিরতরে সমাহিত করা হয়। তার অমর বাণী, "অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।" অনাড়ম্বর যাপিত জীবন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সংগ্রাম করে অধিকার আদায় তার জীবনের এই তিন শিক্ষা আমাদের চলার পাথেয়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ