- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন
ছয় দফা দাবি ও এর গুরুত্ব Six Points Programme and its In Importance
পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি আকাশ ছোঁয়া বৈষম্য এবং পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ ঘনীভূত হয়। এই যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে যেভাবে অরক্ষিত রাখা হয়েছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতাকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর করের বোঝা চাপানো হয়। এর ফলে ক্রমশ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি গুরুত্ব পেতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনসাধারণের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ লক্ষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে নেমে পড়েন। অনৈতিক ও অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের জন্য আইয়ুব খানের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। দেশে 'তাসখন্দ চুক্তি' বিরোধী আন্দোলন জোড়ালো হতে থাকে। তাসখন্দ চুক্তিতে কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধানের কথা উল্লেখ না থাকায় জনগণ একে অপমানজনক চুক্তি বলে মনে করে। দেশের এই রাজনৈতিক অচল অবস্থায় বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য 'নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স' আহ্বান করেন। উক্ত কনফারেন্সে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মুক্তির সনদ স্বরূপ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। শেখ মুজিব তাঁর ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলেন, সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে দেখা দেয়। দেশ রক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবি একান্ত বাস্তব ও অপরিহার্য। সে বিষয়ে কারো দ্বিমতের অবকাশ নেই। তিনি আরও বলেন যে, দেশ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন পাকিস্তানের জাতীয় সংহতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা কর্মসূচি অনুমোদন লাভকরে। ১৮ মার্চ ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঐ প্রস্তাবগুলো ব্যাখ্যা সহকারে "আমাদের বাঁচার দাবি-৬ দফা" কর্মসূচি জনগণের মধ্যে পেশ করেন।
ছয় দফা দাবি (Six points programme)
১। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র ২টি বিষয় থাকবে- প্রতিরক্ষা ও দেশ রক্ষা। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (প্রদেশ) হাতে থাকবে। :
৩। দুটি অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) জন্য হয় দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময় যোগ্য মুদ্রার প্রচলন, থাকবে। আর একটি মুদ্রা থাকলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
৪। সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ইত্যাদি ধার্য, ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। ফেডারেল সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য আঞ্চলিক সরকার থেকে একটি অংশ গ্রহণ করবে। এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হবে।
৫। দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব রাখতে হবে এবং এই অর্থ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার একটি অংশ পাবে। বিদেশে বাণিজ্য মিশন প্রতিষ্ঠা এবং আমদানিও রপ্তানি ক্ষেত্রে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে।
৬। দেশ রক্ষার ব্যাপারে স্বনির্ভরশীলতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আলাদা মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠন করতে হবে।
ছয় দফা দাবির গুরুত্ব (Importance of six points programme)
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ছয় দফা কর্মসূচি। বাঙালির অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে এটি ছিল ম্যাগনাকার্টা। ম্যাগনাকার্টা হলো ব্রিটেনের রাজা কর্তৃক জনগণকে মৌলিক অধিকার প্রদানের এক প্রতিশ্রুতি। ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন একগুচ্ছ নাগরিক অধিকার জনগণকে প্রদান করেন, যা জনগণের স্বাভাবিক শোষণহীন সমাজে বেড়ে ওঠার রক্ষাকবচ। ৬ দফার মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, জননিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। ছয় দফার স্বরূপই ছিল স্বাধীনতা। এই ছয় দফার মধ্যে সরাসরি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়নি সত্য কিন্তু প্রতিটি দাবি বিশ্লেষণ করলে স্বায়ত্তশাসনেরই যথার্থতা মিলে। আসলেই এই দাবিগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাণের দাবি, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ও বাঙালির মুক্তির গ্যারান্টি। ছয় দফা দাবির মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করায় আওয়ামী লীগ জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়'।
শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, "ছয় দফা বাংলার শ্রমিক-কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ। ছয় দফা শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনাইয়া আনার হাতিয়ার। ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধদের লইয়া গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমার আত্মপ্রকাশ-আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি। ছয় দফা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ অনাচার ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।" ছয় দফার দাবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ এই দাবিকে স্বাগত জানায়।
ছয় দফা দাবির জনপ্রিয়তায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে পড়ে এবং আন্দোলন দমনে আত্মনিয়োগ করে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফা দাবির বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। তিনি শেখ মুজিব ও তার দলকে বিভেদকারী বলে অভিহিত করেন। তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলবেন এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি প্রদান করেন।
আইয়ুব খানের ইঙ্গিতে পুতুল গভর্নর মোনেম খান শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে। ৮ মে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের রাতে শেখ মুজিব ও তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট সহকর্মীকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের বলে গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফা সমর্থনকারী অনেক নেতা ও কর্মীকে একই আইনে কারারুদ্ধ করে নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ মে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে "প্রতিবাদ দিবস" পালিত হয়। অতঃপর ৬ দফার দাবিতে ৭ জুন পূর্ব বাংলায় গণ আন্দোলন ও হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এতদ্বসংক্রান্ত আন্দোলন ৭ জুনের আন্দোলন নামে খ্যাত। সরকারের হুশিয়ার বন্দী ও নির্যাতনকে উপেক্ষা করে ৭জুন পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। কলকারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। ধর্মঘটি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকে প্রাণ হারায়। তখন থেকে পূর্ব বাংলায় ৭ জুন, ৬ দফা ও স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতীক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

