• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন : ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন : ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন : ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

মুর্শিদ কুলী খান (১৭০৪-১৭২৭)

বাংলার স্বাধীন নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুর্শিদ কুলী খান। তিনি দক্ষিণ ভারতের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তাঁকে হাজী শফী ইস্পাহানী নামে এক মুসলিম ব্যবসায়ী ক্রয় করেন এবং তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ হাদী। শফী ইস্পাহানী তাঁকে নিজ সন্তানের মতো পারস্যে নিয়ে শিক্ষা লাভ করান। শফী ইস্পাহানী কিছুদিন দিল্লির দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময় মুহাম্মদ হাদী দেওয়ান সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শফী ইস্পাহানী মৃত্যুর পর মুহাম্মদ হাদী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হন। এ সময় সম্রাট তাঁকে মুর্শিদ কুলী খান উপাধিতে ভূষিত করেন (১৭০৩ খ্রি.)। শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে সুবাদারের পরেই ছিল- দেওয়ান পদ। মুর্শিদ কুলী খান বাংলার বিশৃঙ্খল রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠন করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এ সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-শান। তিনি অলস ও আরামপ্রিয় লোক ছিলেন। ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব মুর্শিদ কুলী খানকে উড়িষ্যার সুবেদার নিযুক্ত করেন এবং 'জাফর খান' উপাধিতে ভূষিত করেন।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে তিনি স্বাধীনভাবেই বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং নিজেকে বাংলার নবাব বলে ঘোষণা দেন। তার সময় ইংরেজরা বিনা শুল্কে বাংলায়-বাণিজ্য করতে পারেনি। মুর্শিদ কুলী খানের কঠোর শাসনে দেশে শান্তি স্থাপন হয় ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি হয়। শাসন ক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু সংস্কার করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য সংস্কার হলো ভূমি রাজস্ব সংস্কার ও অর্থনৈতিক সংস্কার। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ভূমি রাজস্ব সংস্কার: মুর্শিদ কুলী খানের আগমনের পূর্বে বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা নানা প্রকার সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তখন জায়গির প্রথা প্রচলিত ছিল। সরকারের নিজস্ব খাস জমি বলতে কিছুই ছিল না। ফলে ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের কোনো আয় হতো না। রাষ্ট্রের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল বাণিজ্য শুল্ক। মুর্শিদ কুলী খান বাংলার ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত দুরবস্থা দূর করতে এবং সরকারের আয় বৃদ্ধি করতে দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন- (১) মুঘল কর্মচারীদের সমুদয় জায়গির সরকারি খাস জমিতে পরিণত করা এবং এর পরিবর্তে কর্মচারীগণকে উড়িষ্যার অনুন্নত ও জঙ্গলাবৃত অঞ্চলে জায়গির প্রদান করা। (২) রাজস্ব আদায়ের ভার জমিদারদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে ইজারাদারদের ওপর ন্যস্ত করা। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবিত "মালজামিনী প্রথা" ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলাকে তিনি ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগনায় ভাগ করেন। দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব প্রেরণ করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের ব্যয় এবং রাজপরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব মুর্শিদ কুলী খানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে মুর্শিদ কুলী খান অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে তিনি ইজারাদারদের কোনো প্রকার অবহেলা সহ্য করতেন না। তিনি প্রদেশের সকল আবাদি ও অনাবাদি জমি জরিপ করে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করতেন এবং জমির উৎপাদন শক্তির ওপর ভিত্তি করে রাজস্ব নির্ধারণ করতেন। মুর্শিদ কুলী খান প্রবর্তিত মালজামিনী ব্যবস্থায় অধিকাংশ জমিদার তাঁদের জমিদারি থেকে উচ্ছেদ হলেও তিনি তাদের উপযুক্ত ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন যা 'নানকর' নামে পরিচিত। এছাড়া মুর্শিদ কুলী খান বাংলার বিভিন্ন স্থানের আবাদি জমি সরকারি খাস জমিতে পরিণত করেন।

অর্থনৈতিক সংস্কার: রাজস্ব সংস্কার ছাড়াও মুর্শিদ কুলী খান ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেন এবং আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি পদাতিক এবং অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য তিনি ইউরোপীয় বণিকদের প্রতি উদার ও সহনশীল নীতি গ্রহণ করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় ওলন্দাজ, চুঁচুড়ায় ইংরেজ ও চন্দননগরে ফরাসি বাণিজ্য কুঠি গড়ে ওঠে।

বঙ্গদেশে ইংরেজরা মুঘল সম্রাটদের ফরমান বলে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু মুর্শিদ কুলী খান ইংরেজদের এই সুযোগ প্রত্যাহার করে নিলে ইংরেজ প্রতিনিধি সুরম্যান সম্রাট ফররুখ শিয়ার শরণাপন্ন হন। অতঃপর ইংরেজরা বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময় বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। মুর্শিদ কুলী খানের রাজস্ব ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থায় বেশ পরিবর্তন আসে, অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী হয়। জমিদার ও ইংরেজ কর্মচারীর অত্যাচার, জুলুম থেকে কৃষকরা রক্ষা পায়।

কৃতিত্ব: বাংলার স্বাধীন নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুর্শিদ কুলী খান বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। সামান্য অবস্থা থেকে নিজ যোগ্যতা বলে তিনি বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার পদে উন্নীত হন। তাঁর শাসনামলে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়। বহু পারসিক কবি সাহিত্যিক মুর্শিদ কুলী খানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আগমন করেন এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।

ঐতিহাসিক সলিমুল্লাহ বলেছেন, "শায়েস্তা খানের পর ভারতের কোন অংশে জাফর খানের (মুর্শিদ কুলীর) ন্যায় ধর্ম প্রসারে উৎসাহী নিরপেক্ষ বিচারপতি এবং গুণগ্রাহী আমীর জন্মগ্রহণ করেননি।" সম্রাট আওরঙ্গজেবের ন্যায় তিনিও ছিলেন ধর্মভীরু, গোড়া, সকল প্রকার বিলাস হতে মুক্ত ও উচ্চ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রতিভাবান সুবেদারের মৃত্যু ঘটে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ