- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
প্রবন্ধ রচনা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রবন্ধ রচনা
বাংলাদেশের নদনদী
ভূমিকা: 'নদী এবং বাংলাদেশ'- যেন একই সত্তার আনমনে গেয়ে ওঠা কথা ও সুরের মূর্ছনা। যেন মা-মেয়ের অনন্তকালের 'নাড়ির সম্পর্ক। তাতেই বাংলাদেশ পেয়েছে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা রূপ; পেয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির সৌন্দর্যসভায় সকল দেশের রানির আসন।
বাংলাদেশের নদ-নদী: প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্ট অসংখ্য নদ-নদীবিধৌত পলিমাটি দ্বারা গঠিত এই বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বে সুপ্রাচীন অনেক সভ্যতা যেমন গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করে তেমনি বাংলার প্রাচীন জনপদ ও নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন নদ-নদী অববাহিকায়। বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অসংখ্য নদ-নদীর মধ্যে প্রধান হলো- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, করতোয়া, মহানন্দা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতী, কপোতাক্ষ, কর্ণফুলী, গড়াই, গোমতী, রূপসা, পশুর, কুমার প্রভৃতি। এসব নদ-নদীর স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শে বাংলার বুকে জাগে নবজীবনের স্পন্দন।
পদ্মা: বাংলাদেশের বৃহত্তম নদ-নদীর মধ্যে পদ্মা অন্যতম। এ নদীটি বাঙালির অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় এ নদী বাঙালির প্রাণের বন্ধু। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে 'গঙ্গা' নাম ধারণ করে চঞ্চলা কিশোরীর মতো বাঁধনহারা হয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে এসেছে সমতল ভূমির দিকে। নিরলসভাবে চলতে চলতে অবশেষে ভারতের হরিদ্বারের নিকট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। পূর্বনাম পাল্টিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে রাজশাহী জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুষ্টিয়ার কাছে এসে বাংলার পবিত্র ভূমি স্পর্শ করেছে। কিছুদূর একলা চলার পর গোয়ালন্দের কাছে গিয়ে মিশেছে যমুনা নদীর সঙ্গে। এরপর পদ্মা-যমুনার মিলিত ধারা পদ্মা নামেই চাঁদপুরে গিয়ে মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সাথে। অবশেষে তিন স্রোতের মিলন রাগিণী গাইতে গাইতে মেঘনা নাম নিয়ে আত্মত্মসমর্পণ করেছে বঙ্গোপসাগরের বিশাল বক্ষে। পথ চলতে চলতে পদ্মা বেশ কয়েকটি শাখা নদীর সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে কুমার, মাথাভাঙ্গা; মধুমতী, ভৈরব, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ব্রহ্মপুত্র: ব্রহ্মপুত্রের জন্ম হিমালয়ের কৈলাশশৃঙ্গের মানস সরোবর থেকে। সেখান থেকে সর্পিল গতিতে তিব্বত ও আসামের পার্বত্য পথ অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। কিছুদূর নিজস্ব গতিতে আপন খেয়ালে চলার পর জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ এসে দু ভাগে ভাগ হয়েছে। এক শাখার নাম যমুনা নদী, অপর শাখা বা মূল শাখা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে ময়মনসিংহ হয়ে ভৈরববাজারের কাছে এসে মেঘনার স্রোতধারার সাথে মিশেছে।
যমুনা: যমুনা ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা নদী। এটি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের মূল স্রোত থেকে বিভক্ত হয়ে বাহাদুরাবাদ ও সিরাজগঞ্জের অসংখ্য জনপদে তার অস্তিত্ব জানান দিতে দিতে গোয়ালন্দের কাছে এসে মিশেছে পদ্মার সাথে। এই নদীর উপরই নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু। এর শাখা নদী হলো-ধলেশ্বরী, করতোয়া, আত্রাই, ধরলা প্রভৃতি।
মেঘনা: আসামের নাগা-মণিপুর পাহাড় থেকে উৎপন্ন বরাক নদী সিলেট সীমান্তে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি শাখায় ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই দুটি শাখাই নানা পথ অবিশ্রান্ত পরিক্রমণ করে আজমিরিগঞ্জে কালনী নাম ধারণ করেছে। অতঃপর এই কালনী নামে কিছুদূর গিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। এ নদী ভৈরববাজারের কাছে এসে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে এবং চাঁদপুরে এসে পদ্মার স্রোতধারায় মিশে মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বিশালতায় লীন হয়েছে। এ নদীর কয়েকটি উপনদী রয়েছে। যেমন- মনু, তিতাস, গোমতী, বাউলাই প্রভৃতি।
জীবন-জীবিকায় নদ-নদী: আবহমানকাল ধরে বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদ-নদী জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের জনগণের একটা বৃহত্তম অংশ জেলে সম্প্রদায় এই নদ-নদীর প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ নিয়ে শত শত বছর ধরে বেঁচে আছে। আমরা ভাতে-মাছে বাঙালি। এই মাছের প্রধান উৎস বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী। সারাবছরই জেলেরা বিভিন্ন উপায়ে এই নদী থেকে মাছ শিকার করে। মাছ শিকার শুধু জেলেদের জীবিকাই নয়, বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পদ্মা-মেঘনার ইলিশ পৃথিবী বিখ্যাত। তাছাড়া এই নদী থেকে আহরিত অন্যান্য মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়।
নদ-নদীর বর্তমান অবস্থা: যুগ যুগ ধরে বাংলার বিশাল জনপদকে যে নদী আপন মমতায় লালন করেছে সেই নদীর বেশিরভাগই এখন, মৃতপ্রায়। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন স্রোতহীন তরঙ্গহীন খালের মতো শীর্ণকায়। তার বুকে যেখানে সেখানে জেগে উঠেছে চর। তিস্তা নদীর উপর ভারতীয় অংশে বাঁধ দেওয়ায় এখন শুধু নামটাই আছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা প্রভৃতি বড় বড় নদী এখন বছরের বেশিরভাগ সময় শুষ্ক থাকে। একসময় উদ্দাম উন্মত্ত স্রোতে যেখানে নৌকার মাঝি নৌকা চালাতে ভয় পেত, এখন সেখানে চাষাবাদ হয়। যে করতোয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা পুণ্ড্রবর্ধন, সেই নদী এখন কেবলই ইতিহাস। বৈশ্বিক উষ্ণতা, মানুষের অসচেতনতা, স্বার্থপরতা, প্রাকৃতিক পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের নদ-নদী আজ চরম হুমকির মুখে।
উপসংহার: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও নদ-নদী বাংলাদেশের জন্য প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ দান। শরীরের শোণিত ধারার মতো নদীর স্রোতধারা বাংলার শরীরে প্রাণের সঞ্চার করে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে তোলে বাংলার প্রকৃতিকে।