- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
প্রবন্ধ রচনা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রবন্ধ রচনা
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও তার প্রতিকার
ভূমিকা: পারমাণবিক যুদ্ধ ব্যতীত 'বর্তমানে বিশ্ববাসীর সম্মুখে গুরুতর যে সমস্যা তা হলো জনসংখ্যা স্ফীতিজনিত সমস্যা। একদিক দিয়ে এটি যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। দেশের মোট আয়তনের তুলনায় যদি জনসংখ্যা বেশি হয় এবং তা যদি ক্রমাগত বৃদ্ধিই পেতে থাকে তখন জনসংখ্যাকে সম্পদ নয় বরং সমস্যা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা পরিস্থিতি: বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দরিদ্র জনবহুল দেশ। পঞ্চম আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১ অনুয়ায়ী জনসংখ্যা (সমন্বিত) ১৪ কোটি ৯৮ লাখ (প্রায়)। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ১৬ লাখ (প্রায়) এবং জনসংখ্যা ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫.৩৬ কোটি।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ: বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যার পেছনে কোনো একক কারণ দায়ী নয়; বরং বহুবিধ কারণই দায়ী। নিম্নে কারণগুলো আলোচনা করা হলো-
- ভৌগোলিক কারণ : ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মৌসুমী অঞ্চলে অবস্থিত। ফলে দেশের আবহাওয়ায় ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সেই সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জন করে যা জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিতে বিরাট প্রভাব ফেলছে।
- খাদ্যাভ্যাস: আমাদের দেশের মানুষ অধিক মাত্রায় ভাত, গম, আলু প্রভৃতি শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করে। সে তুলনায় তারা খুব কম পরিমাণই আমিষ গ্রহণ করে থাকে। বেশি মাত্রায় শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করায় তারা অধিক সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা অর্জন করে।
- অজ্ঞতা, অশিক্ষা ও অসচেতনতা : দেশের অধিকাংশ জনগণই অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও অসচেতন। তারা অধিক মাত্রায় কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে না। এসব কারণে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- পুত্রসন্তান কামনা: বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী পুত্রসন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের বৈজ্ঞানিক কারণ সম্পর্কে জানে না। তাই পুত্রসন্তান কামনায় তারা একাধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে।
- অর্থনৈতিক কারণ : প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অনেক পিতা-মাতাই মনে করে যে পুত্রসন্তান অর্থনৈতিক আয়ের জন্য খুবই সহায়ক। এছাড়া পুত্রসন্তানের মাধ্যমে যৌতুকও লাভ করা যায়। তাই পুত্রসন্তান লাভের আশায় অনেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে না।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে জনসংখ্যা স্ফীতির প্রভাব: বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র জনবহুল দেশ। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনসংখ্যাবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ভিক্ষাবৃত্তি, দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, নিম্ন মাথাপিছু আয়, নিম্ন জীবনমান, স্বাস্থ্যহীনতা, মাদকাসক্তি প্রভৃতি নানা সমস্যায় জড়িত। এসব সমস্যার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী জনসংখ্যাস্ফীতি। নিম্নে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনসংখ্যা স্ফীতির যে ক্ষতিকর প্রভাব বিদ্যমান তা আলোচনা করা হলো:
- খাদ্য ঘাটতি: খাদ্য ঘাটতি বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর এর প্রধান কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদনে অসামঞ্জস্য। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে খাদ্য আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮.৬৬ লক্ষ মেট্রিক টন।
- বেকারত্ব বৃদ্ধি: ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো বেকারত্ব। জনসংখ্যা বৃদ্ধিই বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা অনুসারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না বলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
- বাসস্থান সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাসস্থানের সমস্যা ও বস্তি সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ব্যাপকহারে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করেও এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর ফলে অনেক মানুষ খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাতে জীবন যাপন করছে।
- শিক্ষা বিস্তারে সমস্যা: অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সকল নাগরিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি না করার কারণে অনেক মানুষ নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে।
- পরিবেশ দূষণ: অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বনভূমি ধ্বংসের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার কালো ধোঁয়া, রাসায়নিক বর্জ্য প্রভৃতি পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। বর্ধিত জনসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পয়প্রণালি, শৌচাগার প্রভৃতি নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না বলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
এছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমির ওপর চাপ বাড়ছে, দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় বাংলাদেশের মতো স্বল্পায়তনের উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ বিশাল জনসংখ্যা এক বোঝা স্বরূপ। এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। তবে কোনো একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। নিম্নে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
- জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন জনসংখ্যা সমস্যার সমাধানে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
- পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ: জনসংখ্যা সমস্যা মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করে অধিক সংখ্যক মাঠকর্মী ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, ক্লিনিক স্থাপন এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে মানুষ সচেতন হবে এবং এ পদ্ধতি গ্রহণ করবে।
- শিক্ষার প্রসার শিক্ষার মাধ্যমে জনগণ অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে জানতে পারবে। তাই জনসংখ্যা সমস্যা মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। প্রচলিত খাদ্য তালিকা পরিবর্তন করতে হবে। এতে প্রজনন ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাবে।
- 'সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ: ব্যাপকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে যেন ভবিষ্যৎ ও বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা হলেও কমে আসে। কারণ সামাজিক নিরাপত্তার কারণে আমাদের দেশের জনগণ অধিক সন্তান জন্ম দেয়।
- সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে জনগণকে এর ক্ষতিকর প্রভাব 'সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষা কর্মসূচি, আলোচনা সভা, বেতার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম, নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে জনসংখ্যা সমস্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
উপরে আলোচিত উপায়সমূহের পাশাপাশি নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিকরণ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম: বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা সমস্যাকে দেশের এক নম্বর সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্যা সমাধানে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
নীতিমালা প্রণয়ন: বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এ নীতিমালার দুটি দিক রয়েছে-
- গর্ভনিরোধ পদ্ধতির বর্ধিত চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত ও সহজ গর্ভনিরোধ পদ্ধতির ব্যবস্থা করা।
- স্বাস্থ্যগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের নতুন চাহিদা সৃষ্টি।
উপরে বর্ণিত কার্যক্রমগুলো ছাড়াও সরকারি পর্যায়ে রয়েছে তথ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ কার্যক্রম এবং জনসংখ্যা বিষয়ক গবেষণা, মূল্যায়ন এবং পরিবীক্ষণ কার্যক্রম।
উপসংহার: জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান নিয়ামক হলো জন্মহার। এই জন্মহার হ্রাসকরণে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে আরও বিস্তৃত ও আধুনিক করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গ্রামভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তারের ওপর জোর দিতে হবে। একটি দেশের জনশক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমেই সে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করে।