• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

বই পড়ার আনন্দ

ভূমিকা: সৃষ্টির প্রথম প্রভাতে মানুষ নিজেকে জেনে সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি। অন্যের কাছে নিজেকে জানাতে চেয়েছে সে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখানুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করে তৃপ্ত হতে চায়। এই জানানোর মধ্য দিয়েই তার আনন্দ। এই আনন্দের যোগান দিতে পারে বই। আরবি ভাষায় একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে 'অখাইরো জালিদিন ফিজ জমানে কিতাবুন'। অর্থাৎ, সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হলো বই। কেবল তাই নয়, বই মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশমাধ্যম। বই মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে চিরকাল। তাই মানবজীবনে বই পাঠের গুরুত্ব অনেক।

বই পড়ার গুরুত্ব: সুধী ব্যক্তিরা বলেন, "Reading maketh a man complete" অর্থাৎ, কেবল অধ্যয়নই মানুষের জীবনে পরিপূর্ণতা দান করতে সক্ষম। একথা বলাবাহুল্য, বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষই অপূর্ণতার বেদনায় আক্রান্ত। তাই বাস্তবে অপূর্ণ মানুষ গ্রন্থের মাঝে পূর্ণতার স্বাদ পেতে চায়। শুধু তাই নয়, বিশাল ব্রহ্মান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভের একান্ত প্রয়োজন। তাই বই পড়া মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বই পড়া সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, "জ্ঞানের ভান্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয় এ সত্য তো প্রত্যক্ষ। কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভান্ডার শূন্য, সে জাতি ধনের ভাঁড়েও ভবানী। তারপর যে জাতি মনে বড়ো নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড়ো নয়; কেননা, ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞানসাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টিও মনসাপেক্ষ।" মানুষের এই মন সচল এবং সমৃদ্ধ হয় বই পড়ার মাধ্যমে। কাজেই বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

বই বিনোদনের মাধ্যম: বেঁচে থাকার স্বার্থেই মানবজীবনে আনন্দ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তব সংসারে নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত এবং নিষ্কলুষ আনন্দ খুঁজে পাওয়া বড়ো কঠিন। আমরা দেশ ভ্রমণ করে আনন্দ লাভ করতে পারি। কিন্তু সেখানে অটুট স্বাস্থ্য ও অঢেল টাকার প্রয়োজন। তা অনেকেরই নেই। আমরা তীর্থক্ষেত্র পরিভ্রমণ করে, ধর্মকর্ম পালন করে, লোকসেবা করে, ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, গান গেয়ে আনন্দ পেতে পারি। কিন্তু এসব উৎস থেকে আহরিত আনন্দ সকলে সবসময় সমানভাবে লাভ করতে পারে না। এসবের তুলনায় বই একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ মাধ্যম। কারণ একটি দুটি নয় নানা বিষয় ও' নানা রুচির ওপর অজস্র বই রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কাজেই আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ রূচিমাফিক বই বেছে নিতে পারি এবং আমাদের বাছাই করা বইয়ে চিরকালের আনন্দ খুঁজে পেতে সক্ষম হই।

নিঃসঙ্গ জীবনে বই: নিঃসঙ্গতার সঙ্গী বই। জনৈক মনীষী বলেছেন, "বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিত্য কথা হয়। আর নিত্য কথা বলা থেকেই জন্ম নেয় এক অনাস্বাদিতপূর্ণ আনন্দের। বই তাই মানুষের অবসাদক্লিস্ট মুহূর্তকে ভুলিয়ে দিতে পারে আনন্দের অমিয়ধারায় প্লাবিত করে দিয়ে।" বইকে তাই বলা হয় অবসর যাপনের উৎকৃষ্ট সঙ্গী। প্রকৃতপক্ষে বইয়ের মতো এমন আনন্দদায়ক সঙ্গী পৃথিবীতে আর নেই। এজন্যই ওমর খৈয়াম বেহেশতের সরঞ্জামের তালিকা করতে গিয়ে বইকে বাদ দিতে পারেন নি। তিনি বলেছেন, "রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বই থাকবে 'অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়'।"

মানুষ যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, বার্ধক্যে জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে তখন সে বড়ো বেশি নিঃসঙ্গ ও একাকী হয়ে যায়। মানুষের সেই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কেবল একটি সুন্দর বই-ই প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে, একাকীত্ব দূর করতে পারে।

চিত্তের প্রশান্তি: যে মানুষ বই পড়ে, সে মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে, "মুক্ত কর হে সকল বন্ধন, যুক্ত করহ সবার সঙ্গে।" আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বুড়ো আংলা' বইটি পড়লে সেই কল্পিত সুবচনী হাঁসের ডানায় চড়ে বাংলাদেশের জন্মভূমি থেকে সুদূর হিমালয়ের মানস সরোবর পর্যন্ত এক রোমান্টিক ভ্রমণের দারুণ আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হই।

বই পড়া নিয়ে প্রমথ চৌধুরীর অভিমত: বই পড়ার পক্ষে প্রমথ চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "বই পড়া যে ভাল, তা কে না মানে? আমার উত্তর সকলে মুখে মানলেও কাজে মানে না। মুসলমান ধর্মে মানবজাতি দুই ভাগে বিভক্ত। এক যারা কেতাবি, আর এক যারা তা নয়। বাংলায় শিক্ষিত সমাজ যে পূর্বদলভুক্ত নয়, -একথা নির্ভয়ে বলা যায় না; আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটের উপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, সে দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়; কেননা, সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না।"

উপসংহার: মহাকালের স্রোতে সকল সৃষ্টি এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের দিকে, মৃত্যুর পানে। মানবজীবনও নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী। 'স্বপ্নায়ু এ জীবনে প্রতিটি মানুষের উচিত হাতের কাছে বইটি টেনে নিয়ে যখন যতটুকু আনন্দ রসধারা পাওয়া যায় সেটুকু তৃপ্তি সহকারে আস্বাদন করা। মানুষের অনেক আনন্দের মধ্যে বই পড়ার আনন্দই সর্বোৎকৃষ্ট। কারণ বই মানুষকে নরকের প্রজ্বলিত আগুনের মাঝে ফুলের হাসি ফোটানোর দুঃসাহস দান করে।