• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

বাংলা নববর্ষ

নববর্ষ দিনে আজ চিত্তে বাজে গভীর সঙ্গীত
নূতন উঠিছে স্ফুরি দিশে দিশে জাগিছে সুন্দর।
নবশ্যাম তৃণ দলে তরু শিরে কাঁপে থর থর
নবীনের আবির্ভাব স্পর্শ করি অন্তর নিভৃত। - সূফী মোতাহার হোসেন

ভূমিকা: নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিন। নববর্ষের দিনটি বিগত বছরের বিদায় এবং নতুন। 'বছরের আগমন নির্দেশ করে। পৃথিবীর সর্বত্র নববর্ষ একটি ট্রেডিশন বা ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পয়লা বৈশাখকে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলা নববর্ষ হিসেবে। বাঙালির স্বকীয়তা স্ফুরণে এ দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সব দেশেই নববর্ষ উদযাপিত হয়, তবে বিভিন্ন দিনে। এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্য, যা আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। নববর্ষ পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার দিন। এ সময়ে নানা উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র নববর্ষ উদযাপিত হয়ে থাকে এবং অতীতের সমস্ত দুঃখ-বেদনা ভুলে এদিন থেকে নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু করা হয়।

নববর্ষের ইতিহাস: পয়লা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়েই দেশের জনগণের মনে নতুন করে জাগ্রত হয় কর্মের প্রেরণা। যতদূর জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবর যেদিন সিংহাসনে আরোহণ করেন সেদিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছিল। বাংলা সনের মূল স্রষ্টা ফতেউল্লাহ সিরাজী। উৎপত্তির সময় থেকেই এদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের চাষাবাদ, খাজনা শোধ, বছরের হিসেব-নিকেশ, বিয়ের তারিখ নির্ধারণ সবকিছুই বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে করে আসছে। ব্যবসায়ীরা নতুন 'হালখাতা' শুরু করে নববর্ষের প্রথম দিন থেকে। এদিন থেকে শুরু হয় নানা মেলা এবং উৎসব আনন্দ।

নববর্ষের উৎসব: নববর্ষ কেবল অতীতের দুঃখ বেদনা ভুলে, পুরাতনকে বিদায় আর নতুনকে স্বাগত জানিয়ে জীবন শুরু করার দিনই নয়, এদিন থেকে শুরু হয় নানা উৎসব আয়োজন। নববর্ষের উৎসবগুলোর মধ্যে হালখাতা, পুণ্যাহ, বৈশাখী মেলা বা বার্ষিক মেলা উল্লেখযোগ্য।

হালখাতা: 'হালখাতা' নববর্ষের একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা দেশীয় রীতিতে হিসেব-নিকেশ করেন তাদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানটির প্রচলন এখনো রয়েছে। 'হালখাতা' এখনো যথারীতি খোলা হয়। এখনো দেশীয় ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পয়লা বৈশাখের আগের দিন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলা হয়। তারপর পুরাতন বছরের হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে নতুন বছরের হিসেব রাখার জন্য খোলা হয় 'হালখাতা'। ব্যবসায়ের সাথে বা নানা কাজে কর্মে যারা জড়িত থাকে, তাদেরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।

পুণ্যাহ বাংলা নববর্ষের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল 'পুণ্যাহ'। 'পুণ্যাহ' শব্দের মৌলিক অর্থ পুণ্য কাজ অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিষ শাস্ত্রানুমোদিত প্রশস্ত দিন। কিন্তু বাংলায় এর অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন। বাংলা নববর্ষে জমিদার ও বড় বড় তালুকদারদের কাছারিতে পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো। যদিও অধিকাংশ পুণ্যাহ পয়লা বৈশাখে উদযাপিত হতো, বেশ কিছু পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো সারা মাস ধরে। এদিনে প্রজারা ভালো কাপড় পরে জমিদার ও তালুকদার বাড়িতে খাজনা দিতে আসত। প্রজারা তাদের বকেয়া বা অতীত বছরের খাজনা আংশিক বা পুরোপুরি শোধ করে দিত এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এদিনে জমিদার ও তালুকদারগণ প্রজাদের পানসুপারি এবং মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

বৈশাখী মেলা বা বার্ষিক মেলা: নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈশাখী মেলা বা বার্ষিক মেলাও একটি। নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ, পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলাদেশে ছোট বড় অনেক মেলা শুরু হয়। স্থানীয় লোকেরাই এসব মেলার আয়োজন করে থাকে। মেলাগুলোর স্থায়িত্বকাল সাধারণত এক থেকে সাত দিন। তবে কোথাও কোথাও এসব মেলা সারা বৈশাখ মাস ধরে চলে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার নেকমর্দানে পয়লা বৈশাখে যে মেলা বসে, তা হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমকপূর্ণ মেলা। সাধারণত এ মেলা এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। উত্তরবঙ্গের হেন বস্তু নেই, যা এ মেলায় পাওয়া যায় না। এ মেলাকে সর্বসাধারণের আনন্দ দানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। নাচ, গান, নাগরদোলা প্রভৃতি এ মেলার আনন্দদায়ক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার উদ্যোগেও বৈশাখী মেলা বা বার্ষিক মেলা উদযাপিত হয়।

নববর্ষের বৈচিত্র্য: নববর্ষের পয়লা বৈশাখ আমাদের যাত্রা শুরুর লগ্ন। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের মানুষের সব আনন্দ উৎসবের নিবিড় সংযোগ রয়েছে ফসলের সাথে। নববর্ষের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বোনার আনন্দ। চৈত্র মাসের অবসানের সাথে সাথে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নতুন প্রাণের সাড়া জাগে। চৈত্রের পাতা ঝরার শেষে বনভূমি সব নতুন পত্রপুষ্পদলে অপরূপ হয়ে ওঠে। নব কিশলয়ের স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়ার শোভায় দোয়েল, কোয়েল, বউ কথা কও পাখির গানে মরুময় জীবনেও আনন্দের বান ডেকে যায়।

বাংলাদেশের মানুষের মনে নতুন আবেগ জাগিয়ে তোলে। পৃথিবী যে তার নিজস্ব নিয়মে চলছে, নববর্ষের আগমনে সকলের মনে এ চির পুরাতন কথাটি নতুন করে জাগ্রত হয়। পয়লা বৈশাখ বিগত বছরের সমস্ত সুখদুঃখের স্মৃতির মাধ্যমে মনকে বিষাদময় করে তোলে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে আগামী বছরের সম্ভাবনাও আমাদের জন্য নিয়ে আসে এক আনন্দের ইশারা।

নববর্ষ আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য। এটি এমন একটি ঐতিহ্য যার বয়সের কোন গাছপাথর নেই। গোড়ার কোন সুনির্দিষ্ট বছরের সাথেও এর কোন যোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ বাঙালির চেতনায় এর প্রভাব গভীরতম। সবকিছু মিলিত হয়ে নববর্ষে দেশটা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।

উপসংহার: বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিন। এদিন থেকে নতুন করে শুরু হয় আমাদের জীবন। আনন্দের ভেতর দিয়ে উদ্যাপিত হয় বৈশাখের প্রথম দিনটি। সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে সাড়া দেশে এক অভিজাত সাংস্কৃতিক রূপ মূর্ত হয়ে ওঠে।