- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
প্রবন্ধ রচনা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রবন্ধ রচনা
শহিদ মিনার
ভূমিকা: দেশ ও জাতির কল্যাণে যাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়ে থাকেন তাঁরাই শহিদের মর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি শাসক ও শোষকগণের হস্তক্ষেপে বার বার এ দেশে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। দেশ বিভাগ, বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন, ৫২'র ভাষা আন্দোলন কিংবা ৭১'এর স্বাধীনতার যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি হাজার শহিদ ভাই-বোনদের আর তাঁদেরকে স্মরণ করতেই গড়ে উঠেছে শহিদ মিনার। এ ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন তাঁদেরকে স্মরণপূর্বক সর্বপ্রথম বাংলাদেশে শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়েছিল।
শহিদ মিনার স্থাপনের প্রেক্ষাপট: আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা জন্মের পরই 'মা' বলে বাংলা ভাষাতে মাকে ডেকে থাকি। এই মা ডাক রুদ্ধ করতে শত্রুরা এ দেশের মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। তাঁরা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন অনেকটা জোরপূর্বক। কিন্তু মায়ের ডাক মায়ের ভাষার অকৃত্রিম বাঙালি স্বভাব তাতে আপত্তি তুলেছে। তাই মায়ের ভাষা আপন সত্তায় রেখে এ ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তারা রাজপথে নেমেছিল। আর তখনই এ প্রতিবাদের কারণে তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবেই তাঁরা শহিদ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁদের অমরত্বের শিখা জ্বালিয়ে রাখতেই নির্মাণ করা হয়েছিল শহিদ মিনার।
বস্তুত ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ডাকা অধিবেশনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেছিলেন 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।'- এ ঘোষণা কেউ স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে নি। তাই এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদ দিবস পালন, ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। সেখান থেকে ঘোষণা করা হয় যে ২১ 'ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হবে। এ ঘোষণা শোনা মাত্র শাসকগোষ্ঠী ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সকল প্রকার সভা, মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু আমাদের ছাত্র-জনতা এ বাধাকে অতিক্রম করে, মিছিলে মিছিলে এই প্রতিবাদের আন্দোলনে আরো জোরদার হয়ে ওঠে।
ঢাকা মেডিকেলের সামনে আসতেই পুলিশের গুলি তাদের উপর আসতে থাকে। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর সহ আরো অনেকে। তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থেই গড়ে ওঠে শহিদ মিনার।
প্রথম শহিদ মিনার: ২১ ফেব্রুয়ারির শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সর্বপ্রথম একটি শহিদ মিনার স্থাপন করেন। এ কাজে অংশ নিয়েছিল তিনশত ছাত্র ও ২ জন রাজমিস্ত্রি। সাইদ হায়দার নামক বিশিষ্ট নকশা পরিকল্পনাকারী এ শহিদ মিনারের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। এ নকশাটিতে তৎকালে এই নির্মিতব্য শহিদ মিনারের উচ্চতা নয় ফুট থাকলেও তৈরির পর এর উচ্চতা হয় ১১ ফুট। শহিদ শফিউরের পিতা ২৪ ফেব্রুয়ারি এ শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন। কিন্তু এটি শাসকগোষ্ঠী ভেঙে দিয়েছিলেন। তবে বাঙালির হৃদয় থেকে শহিদের মর্যাদার স্মৃতির মিনার তারা ভেঙে দিতে পারে নি। কবির ভাষায় বলতে শুনি
"ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙ্গুক-
একটি মিনার গড়েছি আমরা চারকোটি পরিবার।"
প্রভাবে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যেন শহিদ মিনার গড়েছিল।
বর্তমান শহিদ মিনার স্থাপনের প্রেক্ষাপট: বর্তমান শহিদ মিনারটির নকশা করেছিলেন স্থপতি হামিদুর রহমান। ঢাকা মেডিকেল সন্নিকটে যে শহিদ মিনার রয়েছে সেটি হামিদুর রহমানের প্রবর্তিত নকশাকে হুবহু প্রতিস্থাপন। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিসহ বাঙালিরা এখানে এসে তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানায় শহিদদের প্রতি। তাই তারা প্রাণের আবেগে গেয়ে ওঠে-
"আমার ভাইয়ের রক্তেরাঙানে একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।"
এভাবে তাঁরা শহিদকে সম্মান জানিয়ে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। বর্তমানের বাংলাদেশে হামিদুর রহমান প্রবর্তিত নকশার আদলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শহিদ মিনার গড়ে উঠেছে।
তাৎপর্যবাহী বাঙালির শহিদ মিনার শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলোকে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাঝখানের সর্বোচ্চ স্তম্ভটি হলো আমাদের বাঙালির মা। চারপাশের ছোট ছোট ৪টি স্তম্ভ হলো সন্তানের প্রতীক। যাঁরা তাঁদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছিলেন। এঁরাই যেন আমাদের প্রেরণার উৎস। কেবল ভাষা আন্দোলন নয় মুক্তিযুদ্ধেও এ শহিদ মিনার বাঙালিদের প্রেরণা যুগিয়েছিল। তাই যুদ্ধ জয়ের অন্যতম প্রেরণার প্রতীকরূপে শহিদ মিনারের তাৎপর্য অশেষ গুরুত্ব বহন করে।
শহিদ মিনার ও বাঙালি সংস্কৃতি: বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে আজ শহিদ মিনারের সম্পর্ক যেন জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
দেশে কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার প্রতিরাদ করতে হলে এখান থেকেই প্রতিবাদের সূত্রপাত ঘটে। বিভিন্ন পর্যায়ের জাতীয় অনুষ্ঠান শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার জাতীয় কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় তাঁকে শহিদ মিনারের প্রাঙ্গনে এনে। এভাবে শহিদ মিনার যেন বাঙালির সাংস্কৃতিক বা ঐতিহ্যে মিশে গিয়েছে।
উপসংহার: শহিদ মিনার আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতীক, আবার এদেশের সকল কাজের প্রেরণার উৎস হলো শহিদ মিনার। শহিদ মিনারের তাৎপর্য আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছি আমরা ২১ ফেব্রুয়ারির কারণে। আর এ কারণেও এই শহিদ মিনার সকল বাঙালির কাছে মর্যাদায় অমলিন হয়ে রয়েছে। ফলে বাঙালির সঙ্গে বিশ্বের সকল মানুষ আজ শহিদ মিনারকে যেন বাংলা ভাষার মর্যাদায় আসন করে তুলেছেন।