• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

দেশভ্রমণে শিক্ষা ও আনন্দ

ভূমিকা: অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের মন সদাই উন্মুখ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে ছুটে যেতে চায় সংসারের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে অবাধ মুক্তির মধ্যে। ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা মানুষের ধর্ম নয়। বিরাট বিশ্বের অন্তহীন অসংখ্য বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে পাহাড়ে-পর্বতে, নদীনির্ঝরে, অরণ্য-কান্তারে। বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবনযাপনের বিচিত্র ধারায় আর সমাজ-সংস্কৃতিতে। সবকিছুকে জানার কৌতূহলই মানুষকে টেনে এনেছে অনন্ত পথের ধুলোয়। বিপুলা এ পৃথিবী প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানায় তাকে, আর সে আহ্বানে সাড়া দিয়েই মানুষ হয় চিরপথিক।

চলাই মানবজীবনের মূলমন্ত্র: মানুষ চিরপথিক, পথ চলাতেই তার আনন্দ। উপনিষদের মধ্যে তাই ঋষিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে পথ চলার মন্ত্র: চরৈবেতি! চরৈবেতি! এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। বিপুল, বিশাল এ বিশ্বে গতিই সত্য, গতিহীনতায় আসে মৃত্যু। গতিময় জীবনের এ রহস্য উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই মানুষ অনন্তকাল ধরে এ সত্যকে মানব জীবনের মর্মবাণী করে নিয়েছে। সে চায় প্রকৃতির রূপ, রস, রহস্য ও সৌন্দর্যকে আস্বাদন করতে, মানব জীবনের অজানা কথা উন্মোচন করতে। আর এরই আকর্ষণে শুরু হয়েছে তার দেশভ্রমণের পালা।

ভ্রমণের আনন্দ: ভ্রমণের নেশা মানুষের স্বভাবগত। দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ চরিতার্থ করে তার মনের সৌন্দর্য-পিপাসাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সৌন্দর্যের সমারোহ রসিক মানুষদের গভীরভাবে আকর্ষণ করে। ভূপর্যটন তাদের কাছে চরম আনন্দের প্রতীক। প্রকৃতি যে অন্তহীন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, একমাত্র দেশভ্রমণের ফলে তা পূর্ণভাবে উপভোগ এবং আনন্দ লাভ করা সম্ভব হয়। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে অবাধ চলার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই মানুষ আজ সহজেই পারে প্রকৃতি জগতের আনন্দলীলার বৈচিত্র্য উপভোগ করতে। অতীতে মানুষ দেশভ্রমণ করত কখনো দুর্গম পথে পায়ে হেঁটে, কখনো পশুবাহন হয়ে অথবা পশুবাহিত মন্থর গতির যানবাহনে কিংবা পালতোলা জলযানে চড়ে। নতুন নতুন জনপদ, মানবজীবন এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির আকর্ষণে, এভাবে সে অর্জন করেছে বিচিত্র এবং অমূল্য অভিজ্ঞতা। লাভ করেছে অপার আনন্দ।

দেশভ্রমণে শিক্ষা: শুধু আনন্দলাভের আকাঙ্ক্ষাই নয়, শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষাও দেশভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষারই অন্যতম অঙ্গ হলো দেশভ্রমণ। বই পড়ে মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করে তা পরোক্ষ, কিন্তু দেশভ্রমণের মাধ্যমে সে পায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। ইতিহাস ও ভূগোলের প্রত্যক্ষ শিক্ষালাভ করতে হলে যেতে হবে দেশভ্রমণে। দেশভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ পায় সজীব মানুষের সান্নিধ্য, প্রকৃতির প্রত্যক্ষ অনুষঙ্গে পায় অপার আনন্দ, লাভ করে প্রকৃত শিক্ষা। ঐতিহাসিক, সামাজিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ঘটনাবলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করার অথবা ঐতিহ্যানুসরণ করার অন্যতম উপায় দেশভ্রমণ। যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষের ধর্মীয় স্থান বা তীর্থ ভ্রমণের ইতিবৃত্তও অজানাকে জানা, দূরকে কাছে টানার বাসনারই ফল।

ভ্রমণে মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি: পৃথিবীর পর্যটনের ইতিবৃত্তও রচিত হয়েছে এভাবেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকের দল দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার পেরিয়ে পৌঁছেছে দেশ-দেশান্তরে। প্রখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিস, ইবনে বতুতা, ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, ক্যাপটেন কুক কিংবা আমাদের দেশের অতীশ দীপঙ্কর এমনিভাবেই সভ্যতা-সংস্কৃতির সম্যক জ্ঞানলাভের আশায় কিংবা অজানা ভূ-খন্ডকে আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় ভয়কে তুচ্ছ করে পাড়ি জমিয়েছেন অজানার পথে। প্রাণকে তুচ্ছ করে অচেনা পথে' পাড়ি দিয়েছিলেন বলেই অনেক অজানা পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, মরুদেশ কিংবা অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার স্মারক হয়েছে আবিষ্কৃত, মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার হয়েছে পূর্ণ, মানবসভ্যতা হয়েছে সমৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধনেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে দেশভ্রমণ।

জাতীয় সংহতি স্থাপনে দেশভ্রমণ: আধুনিক বিশ্বের মানুষ বিভিন্ন দেশভ্রমণ ও পর্যটনকে গ্রহণ করেছে শিল্প হিসেবে। এ পর্যটনের উন্নতির জন্য তাই শুরু হয়েছে নানামুখী প্রচেষ্টা। পথ ও পরিবহনের উন্নতির জন্য যেমন নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, তেমনি গৃহীত হয়েছে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টির ব্যবস্থা। দেশে দেশে ট্যুরিস্ট ব্যুরো স্থাপিত হওয়ায় পর্যটকদের
সুবিধা হয়েছে। ফলে আজ নানা দেশের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের সহজ সম্পর্ক, ব্যবসায়-বাণিজ্যের হচ্ছে সম্প্রসারণ। এমনকি দেশভ্রমণের মাধ্যমে নিজের দেশের মানুষের হৃদয়ের প্রসারতা, মনের উদারতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায় বলেই জাতীয় সংহতির পথও হয় প্রশস্ত।

উপসংহার: দেশভ্রমণের গুরুত্ব আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। আনন্দের উৎস হিসেবে এবং সেই সূত্রে শিক্ষার অঙ্গরূপেও দেশভ্রমণের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। বহুদেশের বহু মানুষ আজ অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষায়, সুদূরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংকীর্ণ ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদেরও গৃহকোণে বন্দি না থেকে বহির্বিশ্বে মুক্তির স্বাদ পেতে হবে। দেশভ্রমণকে শিক্ষার অঙ্গরূপে গ্রহণ করেই মানবসভ্যতার বিশাল সমুদ্রে হবে অবগাহন। তবেই জ্ঞানের দীনতা যাবে ঘুচে, 'কৌতূহল হবে চরিতার্থ।